বিমানবন্দরে সবচেয়ে ‘গুরুত্বহীন’ লোকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিন
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৪:১৭
বাংলাদেশের উন্নয়নে ‘সবচেয়ে’ বেশি অবদান কোন শ্রেণির লোকের, এ নিয়ে নানা যুক্তিতর্ক চলতেই পারে। এর উত্তরে কেউ হয়তো বলবেন, কৃষকের। কেউ বলবেন, ব্যবসায়ীদের। কেউ বলবেন, শিল্পমালিকদের। কেউ বলবেন, রপ্তানিকারকদের। আবার কেউ বলবেন, প্রবাসীদের। প্রশ্নটা যদি হতো, দেশের উন্নয়নে কোন শ্রেণির লোকদের অবদান রয়েছে, তাহলে উপরের সবগুলো উত্তরই সত্য বলে ধরে নেওয়া যেত। কিন্তু ‘সবচেয়ে’ শব্দটি সঠিক উত্তর নির্বাচনে যে-কাউকে ধন্ধে ফেলবে।
প্রবাস থেকে যারা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান, যাদেরকে আমরা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলে সম্বোধন করি। বর্তমান বাংলাদেশের এগিয়ে চলার পেছনে যে তাদের বড় ধরনের অবদান রয়েছে তা বোধকরি কেউ অস্বীকার করবেন না। সরকার সময়ে সময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে গর্ব করে, তার পেছনে যেমনি প্রবাসীদের বড় একটা ভূমিকা রয়েছে, আবার প্রবাসী আয় কমে যেতে থাকলেও সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মুখে মুখে যাদেরকে আমরা এত সম্মান জানাই, যাদের অবদানের কথা আমরা গাল ভরে স্মরণ করি, বাস্তবে আমরা তাদেরকে কতটুকু মূল্যায়ন করি?
বিদেশগামী বা বিদেশাগতদের মূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় জায়গাটি হচ্ছে বিমানবন্দর। মূল্যায়ন বলতে এখানে আমি বোঝাতে চেয়েছি, কথায় ও ব্যবহারে সম্মান প্রদর্শন ও তাদের প্রয়োজনমতো তথ্যগত বা যে কোনো সহায়তা প্রদান। মানুষকে মূল্যায়নের কথা মনে হলে যে-কারও প্রথমেই মনে আসবে শেখ সাদীর সেই পোশাকের মূল্য গল্পের কথা। ভালো পোশাক সব সমাজেই ভালো মূল্যায়ন পেয়েছে এবং বর্তমানেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। সেই দিক থেকে প্রবাসী শ্রমিকরা প্রথমেই পিছিয়ে যান। আমি সবার কথা বলছি না, তবে প্রথমবারের মতো ছোট কোনো কাজ নিয়ে বিদেশ যাওয়া বেশিরভাগ লোকই আসেন গ্রাম থেকে। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জীবনে এই প্রথম কোনো বিমানবন্দরে প্রবেশ করছেন। অনেকেই হয়তো এর আগে বিদেশ তো দূরের কথা, নিজ বাড়ি ছেড়ে, নিজ গ্রাম ছেড়ে বড় কোনো শহরেও আসেননি। শিক্ষার অভাবে অনেকে বিমানবন্দরের লিখিত নির্দেশনাগুলোও হয়তো ঠিকমতো পড়তে বা বুঝতে পারেন না। নতুন এবং অনভ্যস্ত এক পরিবেশে এসে তারা কী করবেন, কোথায় যাবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। এ অবস্থায় বিমানবন্দরে মূলত এই শ্রেণিটিরই কিছুটা সহায়তার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পোশাক, স্মার্টনেস, আভিজাত্য প্রদর্শনের অভাবে এদেরকেই দেখা হয় নিচু চোখে। আর ভালো পোশাক ও আচার-ব্যবহারের কারণে যাদের প্রতি গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয় তারা আসলে এই পরিবেশে চলতে এতই অভ্যস্ত যে তাদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।
দেশের স্বার্থের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলেও গ্রাম থেকে আসা এই শ্রেণিটিরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কারণ কোনো কোনো শিল্পপতি হয়তো অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন, কিন্তু তারা যতটা রপ্তানি আয় করেন তার কাছাকাছি আমদানিও করেন। ফলে তাদের বৈদেশিক আয়ের খুব কম অংশই আসলে প্রকৃত রেমিট্যান্স। যারা বছর বছর বেড়াতে বিদেশে যান তারা বরং উল্টো দেশের মুদ্রা বিদেশে গিয়ে খরচ করেন। অথচ কমদামি পোশাক পরা, বিমানবন্দরে চলতে ফিরতে না জানা লোকটির পাঠানো রেমিট্যান্সের একশো ভাগই কিন্তু বৈদেশিক আয়। এর বিনিময়ে তারা সরকারের রিজার্ভ থেকে একটি পয়সাও নষ্ট করেননি। একটি শ্রেণি বিদেশে যাওয়ার সময় পকেট ভর্তি ডলার নিয়ে যান, ফেরেন খালি পকেটে। উল্টোদিকে কর্মী হিসেবে বিদেশে যাওয়া প্রতিটি মানুষ কিন্তু যাওয়ার সময় পকেটের খুচরো পয়সাটি পর্যন্ত স্বজনদের কাছে দিয়ে যান, দেশে রেখে যান, আর তাদের পরিশ্রমের বিনিময়ে পাওয়া অর্থের খুব কমই তারা বিদেশে খরচ করেন, বেশিরভাগই পাঠিয়ে দেন দেশে। এ ছাড়া পাসপোর্ট ফি, ট্রাভেল ট্যাক্স, বিমান ভাড়া এবং সরকারকে সব ধরনের ফি তারা অন্য সবার সমানই পরিশোধ করেন। তাই বিমানবন্দরের কর্মীদের উচিত, এই একশোভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারীদের সর্বোচ্চ সম্মান করা। তাদের মনে রাখতে হবে, তাদেরকে দেওয়া সরকারের বেতনটা শুধু স্যুটকোট পরা নামিদামি লোকদের দেওয়া ট্যাক্সের পয়সা থেকে আসে না। বিমানবন্দরে অর্বাচীনের মতো দেখতে সবচেয়ে ‘গুরুত্বহীন’ লোকটিও এক্ষেত্রে সমান অবদান রাখেন।
অনেকেই বলে থাকেন, এরা তো সরকারকে সাহায্য করার জন্য বিদেশে যান না, যান নিজের প্রয়োজনে, নিজের পরিবারের প্রয়োজনে। কেউ কেউ এদেরকে ছোট করার জন্য বলে থাকেন, দেশে কাজ করার যোগ্যতা নেই বলে এরা বিদেশে যান আর টাকা পাঠান নিজ পরিবারের কাছে, সরকারকে তো তারা কোনো টাকাপয়সা দেন না, তাই এদেরকে সম্মান জানানোর কী আছে! যারা এমন কথা বলে বেড়ান তারা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন, পরিবারের কাছে পাঠানো তাদের এই অর্থই আমাদের সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তি। বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়ও সরকার যে বলতে পেরেছে, বৈশ্বিক মহামন্দা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, তা এই প্রবাসী কর্মজীবীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর ভরসা করেই কিন্তু বলতে পেরেছে।
প্রবাসী কর্মীদের অসম্মান করার কথাটা মনে আসতেই আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমাদের দেশের খুব সম্মানিত একজন ব্যক্তি। অনেক ভালো ভালো কাজ করেই তিনি সম্মানের এই জায়গাটা তৈরি করেছেন। সেই সম্মানিত ব্যক্তিটিকে একদিন ইউটিউবে দেখলাম, তিনি তার চারপাশের লোকদের হাসানোর বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন কম শিক্ষিত মধ্যপ্রাচ্যফেরত কর্মীবাহিনীকে। ইউটিউবে দেখা ঘটনাটা এরকম, এই গুণী ব্যক্তিটি বসে বসে গল্প বলছেন। আর তার চারপাশে যারা বসে আছেন তারা শুধুই হাসছেন। তার গল্পটা এরকম, একবার মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ থেকে বিমানে করে ফিরছিলেন ওই গুণী ব্যক্তিটি। বিমানের মাঝরাস্তায় এক ব্যক্তি তার কাছে ইমিগ্রেশন ফরম এগিয়ে দিলেন ফিলাপ করে দেওয়ার জন্য। তিনি যেহেতু শিক্ষিত মানুষ, তাই কার্ডটা ফিলাপ করে দিলেন। এরপরে একের পর এক নাকি ইমিগ্রেশন ফরম তার দিকে আসতেই লাগল। একসময় তার চারপাশে ভিড় জমে গেল। হতে পারে তার গল্পটা সত্য। অথবা আংশিক সত্য। কারণ মালয়েশিয়ার মতো দেশ থেকে আসার সময় আমার চোখে পড়েনি যে কোনো কর্মী তার ইমিগ্রেশন ফরম অন্য কাউকে ফিলাপ করতে দিয়েছেন, ভিড় জমে যাওয়া তো দূরের কথা। অথচ মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে একই শ্রেণির লোক যান বলে আমি মনে করি। এই গল্প যদি সত্যও হয়, আমার মনে হয় এমন একজন গুণী এবং সম্মানীয় মানুষের মুখে মধ্যপ্রাচ্যফেরত এসব কর্মীকে নিয়ে এমন লোক-হাসানো গল্প শোভা পায় না। আমার দৃষ্টিতে এমন একজন গুণী মানুষের চেয়ে দেশের আর্থিক উন্নয়নে একজন কর্মজীবী প্রবাসীর অবদান অনেক বেশি। ইউটিউবে এই ঘটনাটা দেখার পর থেকেই এই সম্মানিত লোকটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা কেন যেন উঠে যায়।
যাই হোক, যারা বিমানবন্দরে কাজ করছেন, তাদের উচিত এইসব ‘অর্বাচীন’ বিদেশগামী বা বিদেশফেরতদের যেকোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসা, তাদেরকে রাস্তাঘাট এবং করণীয় বাতলে দেওয়া। তাদেরকে অযথা হয়রানি না করা। তাদেরকে নীচু দৃষ্টিতে না দেখে সর্বোচ্চ সম্মান করা। তাহলেই তাদের চাকরির দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা হবে বলে মনে করি।
লেখক : সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
জহিরুল ইসলাম বিমানবন্দরে সবচেয়ে ‘গুরুত্বহীন’ লোকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিন মত-দ্বিমত