ভাষাবিকৃতি রুখতে চাই সমন্বিত ভাষানীতি
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১২:৪২
ভাষা-পরিস্থিতি সতত পরিবর্তনশীল। কোনো নির্দিষ্ট দেশের ভাষা-পরিস্থিতি কখনও স্থির থাকে না। কিন্তু ভাষা-পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন ঘটে, তা সেদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অনুকূলেও ঘটতে পারে, আবার প্রতিকূলেও ঘটতে পারে। কোনো দেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে যে পরিবর্তন সূচীত হয়, তা যদি দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অনুকূলে সংঘটিত হয় তাহলে তা হয় গ্রহণযোগ্য; আর যদি এ পরিবর্তন দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিকূলে সংঘটিত হয় তাহলে তা হয় অগ্রহণযোগ্য। কারণ কোনো দেশের ভাষা পরিস্থিতিতে নেতিবাচক পরিবর্তন, সে দেশে দীর্ঘমেয়াদী ভাষা-রাজনৈতিক অস্থিরতা বয়ে আনে।
বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি পরিবর্তিত হচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের ছাপ সমাজ ও সংস্কৃতিতে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ইদানিং বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতিকূলে এতোটাই নেতিবাচকভাবে পরিবর্তন হচ্ছে যে—রীতিমতো তা আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিন যতোই যাচ্ছে, ততোই যেনো এই পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে ভাষা সংশ্লিষ্ট নানা সমস্যা যাকে বলা যেতে পারে ভাষিক সমস্যা। এসব ভাষিক সমস্যার কোনো কোনোটি দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় সমস্যায় রূপ নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত একটি প্রতিসম রাষ্ট্র হওয়ায়, দেশের ভাষা-পরিস্থিতির পরিবর্তনের ফলে উদ্ভূত ভাষিক সমস্যাসমূহ প্রকটভাবে প্রতিভাত হচ্ছে না। সেজন্য দেশের জাতীয় নেতৃত্ব কোনো সময়ই ভাষা-পরিস্থিতিগত সমস্যাকে সমস্যা হিসাবে আমলে নিচ্ছে না। বর্তমান বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় যেসব ভাষিক সমস্যাসমূহ পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তা অনেকটা এমন-
১) ভাষিক আধিপত্যবাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি নেতিবাচক দিকে পরিবর্তিত হচ্ছে। ভাষিক আধিপত্যবাদ হলো ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক অনুবর্তী জাতির ভাষাকে দুর্বল করে দেওয়ার কৌশল বিশেষ । বস্তুত: ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি ইত্যাদি বিদেশি ভাষা কেন্দ্রিক ভাষিক আধিপত্যবাদের কবলে নিপতিত হয়ে বাংলা ভাষা প্রতিনিয়ত তার মর্যাদা ও কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
২) ভাষা-পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় সবচেয়ে বেশি যা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা হলো বাংলা ভাষার অবয়ব, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা। ইংরেজি ও নানা আঞ্চলিক উপাদানে দুষ্ট হয়ে বাংলা ভাষা উচ্চারণ, ব্যাকরণ ও বাগর্থিক মাপকাঠিতে তার সৌষ্ঠব হারাচ্ছে। তাছাড়া বাংলা ভাষা ইংরেজি (ও কোন কোন ক্ষেত্রে আরবি) ভাষার তুলনায় মর্যাদা হারাচ্ছে। শিক্ষা ও ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষাকে আর মর্যাদার চোখে দেখা হচ্ছে না। যে কারণে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে।
৩) বাংলা মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কওমী মাদ্রাসা সমূহে যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও আরবি মাধ্যমে শিক্ষা পরিচালিত হলেও, ভাষা শিক্ষার অব্যবস্থাপনার ফলে এ সব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যথাক্রমে বাংলা, ইংরেজি ও আরবিতে দক্ষতার অবনমন ঘটে চলেছে।
৪) শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ইংরেজি ব্যবহারের ব্যাপকতা বাংলা মাধ্যমের শিক্ষাকে গ্রাস করে চলেছে। ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় ইংরেজি দক্ষতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে পুরো জনগোষ্ঠিকে সাংজ্ঞাপনিক ইংরেজি (communicative English)-তে দক্ষ করার সরকারি ও ধনিক শ্রেণির উদ্যোগ নানান নেতিবাচক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপসর্গের জন্ম দিচ্ছে। এক গবেষণায় থেকে যে সব উপসর্গ চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হলো— ক) দেশে একটি বাংলা বিমুখ নতুন প্রজন্মের সৃজন ঘটছে, খ) ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ইংরেজিকরণ ঘটছে এবং ইংরেজি মাধ্যমে অফিস-আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। গ) বাংলা ও ইংরেজির ভাষা সংসর্গজাত অপসৃষ্টি ইংরেজি-বাংলা মিশেল ভাষা (বাংলিশ)-এর বিস্তার ও প্রচলন ঘটছে, এবং ঘ) দৃশ্যমান ও শ্রাব্যমান এই উভয় প্রকার ভাষিক ভূদৃশ্যে বিশৃঙ্খলা পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
৫) বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সুবিধা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত ও পালি ইত্যাদি ভাষাগুলোকে কেবলমাত্র ধর্মচর্চার মাধ্যম হিসাবে আটকে রাখা হয়েছে। ধর্মচর্চায় ব্যবহৃত এ ভাষাগুলোর শিক্ষায় ও প্রয়োগে প্রচুর জাতীয় বাজেট জড়িত। কিন্তু এগুলো জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির নিয়ামক হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, সেসব উদ্দেশ্যে ব্যবহারে ব্যর্থতার কারণে দেশ আজ বিশ্বায়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
৬) বাংলাদেশের বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া দরকার বিশ্বায়ন আদর্শ ভিত্তিক। কিন্তু বিশ্বায়ন নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে ভাষানীতি সমর্থিত একটি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি না করে, অপরিকল্পিতভাবে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে এবং তা বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। যে কারণে দেশে এখন মেরুদণ্ডহীন বিশৃঙ্খল বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
৭) অপরিকল্পিত ভাষা শিক্ষাব্যবস্থার ফলে শিক্ষাখাতে অহেতুক অপচয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনরূপ নীতি বা পরিকল্পনাকে বিবেচনায় না নিয়ে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বুনিয়াদী শিক্ষা হিসাবে প্রচলন করা হয়েছে। অন্যদিকে, ভাষাগত দক্ষতা মূল্যায়নের বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যে কারণে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যপৃত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতার বিষয়টি প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে রয়েছে। ফলশ্রুতিতে দেশে ভাষা-শিক্ষায় ব্যয়িত অর্থের সমপরিমাণ সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
৮) ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিসমূহের বুলিসমূহকে তার গঠন, মর্যাদা ও প্রায়োগিকতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন না করে সেগুলোকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, আবার কখনও কখনও অবহেলা করা হচ্ছে। সরকারি প্রশাসনের আওতায় পরিচালিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট নামক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পূর্ণ অবকাঠামো ও বাজেট দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভাষা গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে অথচ বাংলা ভাষা উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।
উক্ত ভাষা-পরিস্থিতি বিষয়ক আলোচনা থেকে, যে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে তা হলো—বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি নেতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে নানাবিধ ভাষিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর দেশে দেশে ভাষা-পরিস্থিতির নেতিবাচক পরিবর্তন জনিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা থেকে দেশকে সুরক্ষার লক্ষ্যে ভাষানীতি প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর অনেক দেশেই নেতিবাচক ভাষা-পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে ভাষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিপর্যস্ত ভাষা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীনে আনতে অনুরূপ একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। কারণ একটি জাতীয়তাবাদী ভাষানীতি প্রণীত ও বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশ সরকার ভাষা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হবে এবং তা বাস্তবায়নের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে এবং তা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে বাংলাদেশ ভাষিক সমস্যাজনিত রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে নিষ্কৃতি পাবে।
লেখক: পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির ভাষাবিকৃতি রুখতে চাই সমন্বিত ভাষানীতি মত-দ্বিমত