Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হাওরের কৃষকের হতাশা দূর করতে হবে

রাজন ভট্টাচার্য
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৮:১৯

যে সংবাদের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি, তা পাইনি। হয়ত অনন্তকাল অপেক্ষা করলেই সেই সংবাদের আর জন্ম হবে না। অর্থাৎ গত বছর হাওরডুবির পর বাঁধ নির্মাণে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। কৃষকের আহাজারির পাশাপাশি অভিযোগ শুনেছেন। সব ঘটনা বা অভিযোগ সত্য ছিল না, এটা ঠিক। যা সত্য ছিল সেগুলোর কী কোন প্রতিকার মিলেছে?

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হাওরের সহজ সরল মানুষগুলোকে আশ্বস্ত করেছিলেন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার। কয়টি ঘটনার তদন্ত হয়েছে? তদন্তে কী পাওয়া গেল। কতোজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো? এর কোনকিছুই তো কেউ জানে না। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয় কী? আদৌ কী কোন তদন্ত হয়েছে। হলে- সেই তদন্তের উদ্দশ্য কী দোষীদের চিহ্নিত করা ছিল। তদন্ত কী সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ছিল, নাকি লোক দেখানোর জন্যই। যেহেতু তদন্তের বিষয়ে সবকিছু আড়ালে রয়ে গেছে তাহলে এসব পশ্নের অবতারণা একেবারেই অযৌক্তিক বলা যাবে না। নাকি রাজনৈতিক বিবেচনায় তাদের ভেতরে ভেতরে মাফ করে দেওয়া হয়েছে তাও কিন্তু জানা যায়নি। যদি বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতির তদন্ত হয়ে থাকে তবে তা প্রকাশ করা হোক। কারো দুর্নীতি পাওয়া না গেলে সেটিও জানার অধিকার কৃষকসহ সবার রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালে দেশের হাওরাঞ্চলে রেকর্ড বন্যা হয়েছে। বন্যায় হাওরের সাত জেলার মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনার মানুষ এমন এমন ভয়াবহ থাবা খুব কমই দেখেছে। অকাল বন্যায় ভাটি বাংলার মানুষের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন ফসল গেছে। তবে ফসলের ক্ষতির চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বাঁধগুলোর।

গত বছরের ঘটনার যখন প্রতিকার মিলেনি এর মধ্যেই পুরো হাওরাঞ্চলে এখন বোরো ধান চাষের ধুম চলছে। আবারও বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ধান চাষে মাঠে নেমেছেন কৃষকরা। এবারও সবার মধ্যেই বৃষ্টি আর অকাল বন্যার আতঙ্ক থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এরমধ্যে জ্বালানী তেল, সার, বীজের উচ্চমূল্যেও ঝুঁকি তো রয়েছেই।

প্রকৃতির বিরুদ্ধে কখনও যুদ্ধ করা যায় না, সামলানোও যায় না। প্রকৃতি তার নিয়মে চলবে। তাই এবারও যদি অকাল বন্যায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কষ্টের বিষয় হলো কৃষকসহ হাওরের সাধারণ মানুষ যাদের বিরুদ্ধে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনেছিল এর কোন প্রতিকার তারা পায়নি। তারা মনে কষ্টে রেখেই ফের মাঠে নেমেছে। সরকার চাইলেই কিন্তু রাজনীতির ঊর্ধে গিয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। তাইলে সামনের দিনে ইচ্ছেমত হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকল্পে বরাদ্দকৃত রাষ্ট্রের অর্থ লোপাটে অপরাধীরা হিসাব করত। যা দেশের জন্য নজির হতে পারত।

আসন্ন বোরো ফসল রক্ষায় আবারো গোটা হাওরজুড়ে বেশিরভাগ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অর্থ রবাদ্দ হয়েছে। কাজও চলমান। কিন্তু হতাশার খবর হলো, প্রকল্প শুরুর নির্ধারিত দিন ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র শতকরা তিন ভাগের কাজ শুরু হয়েছে; যাকে ‘নিয়মরক্ষা’ বলছেন কৃষকরা।

গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত বছর সুনামগঞ্জ জেলার হাওরে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ৭২৭টি প্রকল্পে কাজ হয়েছিল। চলতি বছরেও সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার বাঁধে সংস্কার কাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে প্রকল্প শুরুর নির্ধারিত দিন ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র শতকরা তিন ভাগের কাজ শুরু হয়েছে। যা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে কী বলবো এসব কাজে তদারকি করার কেউ নেই! এভাবেই প্রতি বছর রাষ্ট্রের অর্থ পানিতে যাবে। আর কৃষকরা অভিযোগ করতে থাকবে। কোন প্রতিকার মিলবে না। এটা তো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় হাওরের একমাত্র বোরো ফসল নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রি-ওয়ার্ক (সম্ভাবতা যাচাই) শেষ করে প্রকল্প গ্রহণ ও অনুমোদন, ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু এবং আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলায় ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৯৩টি প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঁধের সকল প্রকল্প গ্রহণ ও প্রাক্ষলন শেষ করে সব প্রকল্পে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

এ জেলায় ছোট-বড়ো মিলিয়ে প্রায় ১৩৭টি হাওর রয়েছে। এই হাওরের বেড়িবাঁধের আয়তন প্রায় এক হাজার ৭১৮ কিলোমিটার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছিল।

চলতি মৌসুমে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পাউবো প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। গত অক্টোবর মাস থেকে তাদের ২৭টি দল (সার্ভেয়ার ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী) হাওরে গিয়ে সম্ভাবতা যাচাই করেছে। এটা তো ভালো দিক। যদি শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভালোয় ভালোয় হয়। তবে প্রকল্প গ্রহণের পুরো কাজটি শেষ না হওয়া কিন্তু ভালো নয়।

এক সময় টেন্ডার প্রক্রিয়ায় হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হতো। এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কৃষক আন্দোলনে নামে। সরকার ২০১৭ সালে বিশেষ গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) আইন করে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ কৃষকদের নেতৃত্বে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি-পিআইসি।

উপজেলার বাঁধ ব্যাবস্থাপনা কমিটিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সভাপতি এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী সদস্যসচিব হিসেবে রয়েছেন। তারা প্রকল্প তৈরি করে জেলা বাঁধ ব্যাবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সদস্যসচিব পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠাবেন। নীতিমালা অনুসারে, হাওর এলাকায় প্রকাশ্যে গণশুনানি করে কৃষকদের মতামতের ভিত্তিতে বাঁধ এলাকার কৃষকদের নেতৃত্বে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করার কথা।

নিয়ম অনুযায়ি গণশুনানি করে প্রতিটি প্রকল্পে বাঁধের নিকটবর্তী জমির মালিক বা তিনজন কৃষক, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট একজন সদস্য, সংশ্লিষ্ট এলাকার হাইস্কুল বা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তির নেতৃত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি গঠন করা হয়। তবে এই কমিটি গঠন ও গণশুনানি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ শুরু থেকেই।

মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছিল, প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব প্রকল্প গ্রহণ করে ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা। কিন্তু কোনো সময়ই যথাসময়ে যথাযথভাবে কাজ হয় না। এবারও তাই হয়েছে। বিলম্বে কাজ শুরুর করায় বাঁধে মাটি বসে না। এক পর্যায়ে দারসারা গোছের বাঁধ মেরামত, নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এতে দেখা যায় বৃষ্টি এলে ফাঁক ফোকর দিয়ে ফাটল দেখা দেয় এবং জলের টানে বাঁধ ভেঙে যায়। তবে প্রাক্কলন, প্রকল্প অনুমোদনে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও কাজ শুরু ও শেষ করতে বিলম্ব হয়।

যদিও এবার বলা হচ্ছে, পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্প গ্রহণে সময় লাগছে। কিন্তু প্রকৃতির তো বসে থাকার কথা নয়। প্রয়োজনে ড্রোন সহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত প্রকল্প গ্রহণ ও সময়মতো বাস্তবায়ন করে কৃষকদের ফসল রক্ষায় সাহস যোগানো কঠিন কোন বিষয় নয়।

তেমনি প্রতিটি অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ সুষ্ঠু তদন্ত শেষে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হাওরপাড়ের সহজ সরল মানুষগুলো আরো বেশি স্বস্তি পাবে। তারা প্রতিবার নতুন উদ্যমে ফসল ফলাতে মাঠে নামবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই

মত-দ্বিমত রাজন ভট্টাচার্য হাওরের কৃষকের হতাশা দূর করতে হবে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর