দেশের দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭ তম জন্মদিন আজ (২৮ সেপ্টেম্বর)। তিনি ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মধুমতি নদী বিধৌত টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা‘র জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি তিনি। কৃষিতে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বলেই তার নের্তেত্ব আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
বিগত কয়েক দশক ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে একটি ‘রোল মডেল’ হয়ে উঠেছে, যা দেশকে প্রধান খাদ্যশস্যের জন্য স্বনির্ভর করে তুলেছে। বাংলাদেশ ফসলের জাত উন্নয়নে প্রথম, ধান ও শাক-সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর আভ্যন্তরীন জলাশয়ের মাছ উৎপাদনে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে । দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বছরের পর বছর ধরে কৃষিক্ষেত্রে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছেন।
স্বাধীনতার পর যেখানে ধানের উৎপাদন মাত্র ১.১০ কোটি মেট্রিক টন ছিল, সেখানে বর্তমানে উৎপাদন স্তর থেকে প্রায় ৪ কোটির অধিক মেট্রিক টনে। সময়ের সাথে সাথে আবাদি জমির প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে, কিন্তু আমাদের কৃষি উৎপাদন কমেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের কৃষিক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অসাধারণ। জাতির পিতা কৃষি ক্ষেত্রকে আধুনিকীকরণের জন্য কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন, যা ঐতিহ্যবাহী রীতিতে জড়িত ছিল। একই সঙ্গে তিনি কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যাতে তারা একটি সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। তিনি কৃষিক্ষেত্রে যে সরকারী কর্মকর্তাগণ কাজ করেন তাদের মর্যাদাকেও উন্নীত করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে এক জনসভায় থেকে শিক্ষিত মানুষকে কৃষিক্ষেত্রে তাদের গ্রামে যেতে এবং দেশের উৎপাদনে সহায়তা করার আহ্বান জানান। জাতির পিতার তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, “আমরা যদি একই জমিতে দ্বিগুণ ফসল তুলতে পারি তবে দেশের কোনও খাদ্য সংকট হবে না”। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু উন্নত ও স্বল্প সময়ের চাষ পদ্ধতি, মানসম্পন্ন বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষিজাত সরবরাহ করেছেন এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষিতে ছাড় করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার করে খাস জমি বিতরণ করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকালই কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করে গেছেন । তিনিই প্রথম কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের কৃষি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কৃষিবিদদেরকে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ক্লাস ওয়ান মর্যাদায় উন্নীত করেন। জাতির জনকের দেওয়া কৃষিবিদদের ঐতিহাসিক এই সম্মানকে স্মরণীয় করে রাখতেই প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি জাঁকজমকপূর্ণভাবে কৃষিবিদরা দিবসটিকে কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে পালন করে।
বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের ক্লাশ ওয়ান মর্যাদা দেয়ার পরই কৃষিতে একটি চাঙ্গাভাব পরিলক্ষিত হয়। কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করা হয় রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, আধুনিক কৃষিকে ধারণ ও লালন করার যোগ্য কাঠামো- অবকাঠামো। কৃষি, শিক্ষা, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উপকরণ বিতরণ কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ইত্যাদির সৃষ্টি হয় । আধুনিকায়ন হয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউগুলো। মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও চা উন্নয়নের ক্ষেত্রেও নতুন নুতন উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়।
কৃষিবিদ সামাজ তাদের প্রতিভা, মেধা ও কর্মদক্ষতা সর্বোচ্চ অঙ্গীকার ও আন্তরিকতার সঙ্গে প্রয়োগ করে জাতির পিতার প্রত্যাশা পূরণে ব্রতী হন। তাদের দ্বারা প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ফসলের শত শত প্রবর্তন ও উন্নত প্রজাতির প্রযুক্তির প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ২০১৫ সালে প্রায় ১৬ কোটি জনগণের জন্য ৩ কোটি ৮৪ লক্ষ মেট্রিক টন দানা জাতীয় খাদ্য শস্য উৎপাদন উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাও পরাভূত হয়েছে। আজ এদেশের প্রতি ইঞ্চি জমি ভরে উঠেছে ফসল বৈচিত্রে। শত শত উচ্চফলনশীল ফসল সংযুক্ত হয়েছে শস্য বিন্যাসে, ফল ও মসলা উৎপাদনেও বিপুল অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। শস্যের নিবিড়তা শতকরা ৩০০ ভাগ ছুঁই ছুঁই করছে। কৃষি ক্ষেত্রে লাগাতারভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা, বাংলাদেশে সততা, মানবিকতা ও উন্নয়নের প্রতীক কৃষিবান্ধব মাননীয় প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের অংশীদার কৃষিবিদরা ই-কৃষির মাধ্যমে সারা দেশের কৃষকদের উন্নত বিশ্বের মতো ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার চেষ্টায় রত আছেন ।
প্রাকৃতিক বৈরীতার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপযোগী কৃষি উৎপাদন কৌশল প্রবর্তনে কৃষক ও কৃষিবিদ সমাজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একইভাবে গ্রামে গ্রামে পোলট্রি ফার্ম, গাভী পালন, গরু মোটাজাতকরণ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাণীসম্পদের পাশপাশি পুকুর, বিল, হাওর বাওড় এবং মুক্ত জলাশয়ে মাছ চাষের কার্যক্রম বিস্তৃত হওয়ায় মৎস্য খাতেও প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি সমুদ্র জয়ের ফলে মেরিন ফিশারিজ খাতের উন্নয়নে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি বসতবাড়িতেও ফল ও সবজি চাষ বৃদ্ধি উপকরণের জোগানও বাড়ছে। বহু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এসব কাজে যুক্ত হয়েছে। কৃষি ব্যবস্থায় যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের ছোঁয়া লেগেছে-যা কৃষকের জীবনযাপন এবং কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। কৃষি পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বহিঃবাণিজ্যে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে । এখন কৃষকের ঘরবাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষা-দীক্ষা, বিনোদনসহ জীবনযাত্রার সর্বত্রই লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গাটিতে দাড়িয়ে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন সেই স্থানটিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতি চত্ত্বর’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি চত্বরের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেছিলেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে ১৯৯৭ সালে চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কৃষি উন্নয়নের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়ে ভাষণ দেন এবং কৃষি গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে স্বর্ণপদক ও সার্টিফিকেট বিতরণ করেন। আবার ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১ম বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সবুজ বিপ্লবের জনক নোবেল বিজয়ী কৃষি বিজ্ঞানী ড. নরমান আর্নেষ্ট বোরলগকে সম্মানসূচক ডিএসসি (Honoris Causa) ডিগ্রী প্রদান করেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসন আমলে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করে তিনি প্রবৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশের উপরে নিয়ে আসেন। সুশাসন কায়েম করে তিনি বাংলার মানুষের জীবনে বুলিয়ে দেন শান্তির পরশ। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য বাজেটে কৃষি গবেষণাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উন্নত জাত ও উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবন করে তার সম্প্রসারনের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষে কৃষি গবেষণা ও কৃষি পুর্ণবাসন সহায়তা খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা গবেষণা কার্যক্রমকে গতিশীল করেছে।
বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কেবল অনন্য ব্যক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই স্থান করে নেননি, নিয়েছেন গোটা বিশ্বের মধ্যে যোগ্যতায় ক্ষমতাধর নারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবেও। যা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে যতদিন পৃথিবী থাকবে। তার জয় হোক। জন্মদিনে নিরন্তর শুভেচ্ছা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
লেখক: প্রফেসর, মেডিসিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃৃষি বিশ্ববিদ্যালয়