Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আর্থিক অসাম্য অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনতে পারে

রজত রায়
১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:৩৪

উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়টাতে দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খেলেও উচ্চবিত্তরা বেশ ভালো আছেন। বর্তমানে যেখানে সঞ্চয় ভেঙ্গে চলছেন সাধারণ মানুষ সেখানে দেশের কোটিপতি মানুষের তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন। ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারী সংখ্যা ছিল ৯৮ জন। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ টি, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২ টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭ টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০ টি তে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে কোটিপতি হিসাব দাঁড়ায় ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬টি। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬ টি। ২০২৩ সালের জুন শেষে কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪ টিতে পৌছেছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে যত এগিয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ততই বাড়ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও এর ভাগ সমহারে সবাই পাচ্ছে না। বৈষম্য বাড়ছে বছর বছর। দেশে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৪১ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। ফলে সামগ্রিক থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে অনেক ধরনের অসাম্য ও বৈষম্য বিদ্যমান। বর্তমানে সর্বনি¤œ ও সর্বোচ্চ আয় পার্থক্য ৮০ গুণ যা ২০০৫ সালে ছিল ৩০ গুণ। এ ধরণের বৈষম্য বজায় রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

বিজ্ঞাপন

আমরা ইতোমধ্যেই জানি যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ধনীর সংখ্যা অর্থাৎ কোটিপতিগণের সংখ্যা বেড়েছে। অর্থাৎ ধনীরা আরও অনেক বেশি ধনী হয়ে উঠেছেন। তাহলে দরিদ্ররা কি দরিদ্রতর হলেন? চরম দ্রারিদ্র হ্রাস পাওয়ার পরও কি এমন কিছু দরিদ্র জনগোষ্ঠী রয়ে গিয়েছে যারা দরিদ্রতর হয়েছে? চরম দারিদ্র্যে যদি পতিত নাও হয় আরও অনেক বেশি সংখ্যক পরিবার দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়েছে? মানুষের আয় সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া ভয়ানক কঠিন। কিন্তু জীবনযাত্রার বিভিন্ন সূচক থেকে অনুমান করা চলে যে, এই ঘটনাগুলো সাম্প্রতিককালে ঘটছে।

যদি ধনীরা ধনীতর হয়ে উঠতে থাকেন আর অ-ধনীরা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, তাহলে ধনী আর অ-ধনীদের মধ্যে ব্যবধান বাড়ে, এবং বলা চলে যে, এ ক্ষেত্রে উর্ধ্বমূখী ধাক্কার ফলে অসাম্যের পরিমাণ বাড়ল। অন্যদিকে যদি ধনীরা যেখানে ছিলেন সেখানেই থেকে যান কিন্তু ধনীদের অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে অসাম্যের পরিমাণও বাড়ে। এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে, নিম্নমূখী ধাক্কা লাগার ফলে অসাম্য বৃদ্ধি পেল। তবে এটা কখনও কখনও। কিন্তু তেমন ঘটনা খুব নিয়মিত নয়। কারণ এক জনের ক্ষতি হলে সচরাচর অন্য কারও লাভ হয়। এখন আসা যাক অসাম্যের একটা তৃতীয় ও ভয়ংকর পথ। এই তৃতীয় ক্ষেত্রটিতে ধনীরা ধনীতর হয়ে ওঠেন, দরিদ্ররা দরিদ্রতর হন। এই পরিস্থিতিতে উর্ধ্বমূখী এবং নি¤œমূখী উভয় চাপই কাজ করে অসাম্যের মাত্রার উপর।

প্রশ্ন হচ্ছে দেশে মোট আয়ের পরিমাণ যদি বাড়ে তাহলে আর্থিক অসাম্য বাড়লেই বা ক্ষতি কী? ক্ষতি হল গরীব মানুষ তাদের আয়ের বেশি অংশটাই ভোগ্য পণ্যের পিছনে খরচ করেন এবং বড় লোকদের আয়ের তুলনায় ভোগ ব্যয়ের অনুপাত অনেক কম। ফলে গরীবের প্রকাশ্য টাকা আয় বাড়লে যত টাকা ভোগ ব্যয় বাড়বে বড়লোকের আয় সমান পরিমাণ বাড়লে ভোগ ব্যয় বাড়বে তার চেয়ে অনেক কম। ফলে আর্থিক অসাম্য বাড়লে দেশের আয় যত বাড়ে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা তত বাড়ে না। ফলে আর্থিক অসাম্য অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনতে পারে।

আর্থিক অসাম্য বাড়লে লগ্নিতে অর্থ বিনিয়োগেও লাভের পরিমাণ কমে যেতে পারে। দেশে আর্থিক উৎপাদনের শক্তি যে পরিমাণে বাড়ে, একটা বড় অংশের জনসংখ্যার মূলত শ্রমিক ও কৃষকদের আয় যদি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না বাড়ে তবে দেখা যাবে যত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তত বিক্রি হচ্ছে না। কারণ সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ওপরই দেশের বাজার নির্ভর করে। বিনিয়োগ যে হারে বাড়ছে তাদের ক্রয় ক্ষমতা যদি সে হারে না বাড়ে তা হলে বাজারে চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হবেই। এবং রপ্তানির বাজার না থাকলে দেশের বাজারে জোগানের চেয়ে চাহিদা কম হলে বিক্রি হওয়া পণ্য সংস্থার গুদামে জমতে থাকবে। ফলে বিনিয়োগকারী লাভ ঘরে তুলতে পারবে না। উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করবেন যে, ভবিষ্যতে লাভের পরিমান কম হবে ফলে বিনিয়োগের পরিমাণ ও কম হবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমবে।

অন্যদিকে, নীট রপ্তানির (অর্থাৎ মোট আমদানির সঙ্গে মোট রপ্তানির ব্যবধান) পরিমাণ যদি বাড়ে তা হলেও দেশের বাজারে চাহিদা অনেকটা বাড়তে পারে। কিন্তু যে দেশগুলোতে বাংলাদেশ মূলত রপ্তানি করে সেগুলোর অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের ওপর মোট রপ্তানির পরিমাণ নির্ভরশীল। বর্তমানে বিশ্বে খুব ভাল আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছে না। আর একটা উপায় হল সরকারের অর্থভান্ডার ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে বাজারে চাহিদা বাড়ানো। যদি মানুষকে কম কর দিতে হয় তাহলে হাতে খরচ করার মতো টাকার পরিমাণ বাড়বে। সরকার কোনও ভাবে নিজের খরচ বাড়ালে মানুষের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আয়ের পরিমাণ বাড়বে। তারা সেই টাকা খরচ করলে অন্যদের আয়ও বাড়বে। তারা আবার সেই টাকা পণ্যও পরিষেবার পেছনে খরচ করবেন। দেশে যদি অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা থাকে এবং বেকার শ্রমশক্তি থাকে তাহলে উৎপাদনের পরিমাণও বাড়বে। অর্থনীতির ভাষায় এরই নাম কেন্স-কান মাল্টিপ্লায়ার প্রসেস।

অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে আর্থিক বৃদ্ধির অন্য একটা পথও আছে। মজুরী ও বেতনবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল আর্থিক বৃদ্ধি। এই পথে হাঁটলে গোড়াতেই আয়ের বন্টন সুষম হওয়া দরকার। যাতে সবার হাতে যথেষ্ঠ টাকা থাকে যাতে সকলের ভোগ ব্যয়ের সামর্থ্য থাকে যাতে সেই ব্যয়ের প্রবণতা বাড়ে। এটা ঠিক যে বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে টাকা থাকার ফলে ভোগ ব্যয়ের প্রবণতা যত বেশি হবে, সরকার একটা বাড়তি টাকা খরচ করলে এক টাকা বেশি লগ্নি হলে বা এক টাকার বিনিয়োগ বাড়লে জাতীয় আয় বাড়বে এক টাকার চেয়ে তত বেশি হারে এবং এভাবে চলতে থাকবে যতক্ষন না গোটা অর্থনীতিতে সবার কর্মসংস্থান হয় অথবা দেশের উৎপাদন ক্ষমতা তার চরম সীমায় পৌছে যায়। বস্তত, সকলকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই হচ্ছে এখন দেশের সবচেয়ে বড় কার্যক্রমের মধ্যে একটি।

প্রশ্ন হচ্ছে নির্ণয় করা যায় কিভাবে? এই বিপুল বৈষম্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যা নির্ণয় করা জরুরি তা হল ‘ইকোনমিক মোবিলিটি’ বা অর্থনৈতিক শ্রেণি বিন্যাসে ওঠানামার হার। সহজ ভাষায় বললে, এই হার দেখায় একটি নির্দিষ্ট সময়কালে সমাজে কত জন মানুষ বা কয়টি পরিবার বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির যেমন, দরিদ্র মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তর মধ্যে ওঠানামা করছেন যা বুনতে সাহায্য করে সেই সমাজ অর্থনৈতিক ভাবে কতটা গতিশীল। অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার নির্নয় করা জরুরী। কারণ ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ভর করে অর্থনৈতিক গতিশীলতার ওপর। অর্থনৈতিক গতিশীলতা বা তার অভাব অসমতার বিরূপ প্রভাবের মাত্রা কমাতে বা বাড়াতে পারে। প্রবলভাবে অর্থনৈতিক গতিশীল একটি অর্থনীতিতে যেখানে পরিবার গুলো আয় বা খরচের বন্ঠনে অবাধে ওঠানামা করে সেখানে স্থায়ী আয় ও খরচের বন্ঠন কম গতিশীলতা যুক্ত অর্থনীতির তুলনায় সুষম হবে। এটা ঠিক যে, সকল পরিস্থিতিতেই অসাম্য বাড়ছে। বস্তুত বাজার অর্থনীতি যে লাভ ভিত্তিক আর্থিক বৃদ্ধির নিয়ম মেনে চলে তাতে অসাম্য বাড়বেই।

আর্থিক সমৃদ্ধির স্বাদ নেয় কর্পোরেট ধনকুবেররা, আর মন্দার ফল ভোগ করেন শ্রমজীবী মানুষ। তাই, ধনকুবেরদের থেকে সম্পদ কর নিয়ে পরোক্ষ কর কমিয়ে অর্থাৎ কর কাঠামোর সংস্কারই অসাম্য কিছুটা কমাতে পারে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আর্থিক অসাম্য অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনতে পারে মত-দ্বিমত রজত রায়

বিজ্ঞাপন

আদানি গ্রুপের নতুন সংকট
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৬

আরো

সম্পর্কিত খবর