গার্মেন্টস শিল্পের অস্থিরতায় কার লাভ
১৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৫০
গত ৭ ই নভেম্বর জাতীয় মজুরি বোর্ড গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছে। যার ফলে গার্মেন্টস কর্মীদের সর্বনিম্ন বেতন এখন ১২ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের একাংশ এই মজুরি মানেননি। এ নিয়ে তারা রাস্তায় আবার নতুন করে আন্দোলন শুরু করার চেষ্টা করেছেন। এর ফলে গত কিছুদিন ধরে গার্মেন্টসে হঠাৎ করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। আর এই উত্তেজনার সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটা যোগসাজশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকে তারা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাম রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির সঙ্গে মিলে আন্দোলন করছে তাদের অনেকেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের উস্কানির সঙ্গে জড়িত এবং এরাই নতুন মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের গূরত্ব অপরিসীম। আশির দশকের গোড়ার দিকে স্বল্প পরিসরে একটি অপ্রচলিত রফতানি খাত হিসেবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ ভাগ আসে এই পোশাক রপ্তানি থেকে। এ খাত শুধু দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে না বৈদেশিক মুদ্রাভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করছে। পরোক্ষভাবে ৪ কোটি মানুষ এই পোষাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যার ৫৫% ই যেখানে নারী। যা নারীর ক্ষমতায়নেও ভুমিকা রাখছে। যেখানে মোট জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নিয়ে কৃষি জিডিপিতে অবদান রাখে প্রায় ১২% সেখানে মাত্র ৪৪ লাখ জনশক্তি নিয়েই পোষাকশিল্প জিডিপিতে অবদান রাখে তার সমান। এই পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার হয়েছে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প ছাড়াও ব্যাংক, বীমা, হোটেল, পর্যটন, শিপিং, আবাসন, প্রসাধনী সামগ্রীসহ বিভিন্ন খাত বিকাশ লাভ করেছে। বিদেশের মাটিতেও দেশের একটা পরিচিতি বেড়েছে পোষাক শিল্পের মাধ্যমে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে তৈরি পোশাক রফতানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশ। ডেনিমের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ অবস্থান প্রথম । সরকারের নীতিগত সহযোগিতা পেলে অতি শিগগিরই ইউরোপের বাজারে শীর্ষস্থান অধিকার করার প্রত্যয়ী এই পোষাকশিল্প।
কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোশাক শিল্পের এই গতিশীলতাকে রুখে দিতে নিজেদের স্বার্থে দেশি ও বিদেশি একটি মহল বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার এবং অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই লক্ষ্যে তারা পোশাক শিল্পে তথা পুরো বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরী করে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসীন হতে বিভিন্ন সমসয় বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে আসছে। অন্যান্য সব ধরনের ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হওয়ার ফলে ঐসব দেশি ও বিদেশি অপশক্তির মূল লক্ষ্য এখন পোশাক শিল্প। যার ফলে নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ হওয়ার পরেও পোশাক শিল্পের অস্থিরতা কমছে না। কারণ ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্যতো নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ নয় বরং নূন্যতম মজুরি নির্ধারণের নামে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করা।
বাংলাদেশোর পোশাক শিল্প নিয়ে দেশি-বিদেশি অপশক্তির এমন ষড়যন্ত্র নতুন কোন বিষয় নয়। পোশাক শিল্পে এই ষড়যন্ত্র অতীতেও ছিল। উল্লেখ্য যে, ২০১৩ সালের দিকে একটি বিদেশি মহল এই পোশাক শিল্পের গতিশীলতাকে ব্যাহত করতে অপপ্রচেষ্টা চালিয়েছিল। বিজিএমইএ সূত্র থেকে জানা যায়, আশুলিয়া, সাভার ও নারায়ণগঞ্জ এলাকাগুলোতে গার্মেন্টস কারখানা বেশি থাকায় বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের কয়েকটি সংগঠন এসব এলাকায় কেবলমাত্র শ্রমিক অসন্তোষ তৈরিতে তখন কাজ করেছিল। আর এসব অসন্তোষ তৈরি হলে বিক্ষোভের সময় ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ছবি বিদেশে পাঠিয়ে দেশের ইমেজ নষ্ট করার পায়তারা করেছিল। এছাড়াও ২০১৩ সাল থেকে পোশাক শিল্পের অগ্রগতি ব্যাহত করতে যে অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা ২০১৬ সালেও বজায় ছিল। যার ফলে তখনো গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংসে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। এনিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলেছিল অপপ্রচার। ভারত, ভিয়েতনামসহ অন্যান্য দেশের কাছে এ শিল্পকে তুলে দিতে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং এখনও করে যাচ্ছে। দেশের শ্রমিকদের উস্কে দেয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার চাপসহ বিভিন্নভাবে গার্মেন্টসে অসন্তোষ তৈরি করে ভাবমর্যাদা ক্ষুণ করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি বিদেশে বায়ারদের কাছে জঙ্গি হামলা বা নিরাপত্তার অজুহাত, কর্ম-পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে।
অতীতের ন্যায় বর্তমানেও আবার এই পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে অস্থিরতা তৈরী করছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তারা শ্রমিকদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে উস্কে দিচ্ছে সাধারণ শ্রমিকদেরকে। যার ফলে হঠাৎ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, মিরপুরসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন, জ্বালাওপোড়াও কর্মকান্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির অশুভ উদ্দেশ্য।
শ্রমিক নামধারী একশ্রেণির নেতা আছেন, যারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। আবার শ্রমিক অধিকার রক্ষার নামে একশ্রেণির এনজিও আছে। তারাই মূলত সম্ভাবনাময় গার্মেন্টস খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উসকানি দিচ্ছে। তারাই সুকৌশলে শ্রমিক অসন্তোষ লাগিয়ে দিয়েছে। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। সেখানে শ্রমিক নামধারী নেতা ও এনজিওগুলোর নাম চিহ্নিত করে লিখিত আকারে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের উসকে দেওয়া ও ট্রেড ইউনিয়ন করার চাপসহ বিভিন্নভাবে গার্মেন্টসে অসন্তোষ তৈরি করে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা চলছে। কোনো কোনো মহল নেপথ্যে থেকে শ্রমিক নামধারী নেতা ও একশ্রেণির এনজিওদের লালনপালন করে। গার্মেন্টস শিল্পে জ্বালাওপোড়াও, ভাঙচুরসহ সহিংস ঘটনা ঘটানো হয়। শিল্পাঞ্চল পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গত এক দশকে গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার নামে শতাধিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে প্রায় দেড় ডজন রয়েছে ফেডারেশন।
বেশির ভাগ সংগঠনের নিবন্ধনও নেই। এসব সংগঠনের নেতাদের বেশিরভাগই গার্মেন্টস কারখানার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্তও নন। এসব ব্যক্তি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের হয়ে কাজ করে থাকেন। তারাই মূলত শ্রমিকদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে নিজেরা ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের চিহ্নিত নেতাদের কেউ কেউ বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। নভেম্বরেই বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা এবং ডিসেম্বর থেকেই বর্ধিত বেতন কার্যকর হবে বিজিএমইএর এমন ঘোষণার পরও থামছে না ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। মালিক পক্ষ, শ্রমিক, সরকার সবাই বেতনের দাবি নিয়ে একমত। তারপরও এমন সহিংসতা শ্রমিক আন্দোলনের নামে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিগুলোর ইন্দনকেই নির্দেশ করছে।
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাবিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে শ্রমিক নামধারী ৩৬ জনের তালিকা পেয়েছে। তাদের মোবাইল ফোন রেকর্ডসহ বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে, এই ৩৬ জন নেতা বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি পুঁজি করে নানা উসকানি ও ইন্ধন দিয়ে গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলনে নামিয়েছেন। নানা উসকানিমূলক কথা বলে শ্রমিকদের খেপিয়ে তুলছেন। তাদেরই উসকানিতে শ্রমিকরা গার্মেন্টস শিল্পে জ্বালাওপোড়াও, ভাঙচুর চালান এবং পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। এসব নেতা গার্মেন্টসে চাকরি করেন না, গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গেও জড়িত না। কিন্তু তারা স্বার্থান্বেষী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট নেতা। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক সংগঠনের নামে কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকেন। ওই সব দেশ তাদের মতলব অনুযায়ী গার্মেন্টস শ্রমিকদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বিক্ষোভে নামার পর থেকে পুলিশ, মালিকপক্ষ এমনকি শিল্প মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গেও শ্রমিকদের কোনো কথা বলতে দিচ্ছেন না এসব শ্রমিক নেতা। উলটো গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনকে উসকে দিচ্ছে শ্রমিক নামধারী ওই চক্রটি। তারাই সুকৌশলে শ্রমিক অসন্তোষ লাগিয়ে দিয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলন থেকে পরিকল্পিতভাবে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে টার্গেট করে তাদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। শান্তিপূর্ণ অবস্থানের পরও হামলার শিকার হচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। ভাঙচুর চালানো হচ্ছে শ্রমিকদের রুটিরুজির পোশাক কারখানাতেও। ফলে শ্রমিকদের এই আন্দোলন আসলে কীসের উদ্দেশ্যে আর এর নেপথ্যে ইন্ধনদাতা কারা সেটিই সম্পর্কে বাংলাদেশের সচেতন নাগরিক সমাজ অবগত। বিজিএমইএ ও গার্মেন্টস শ্রমিক নেতারাও জানিয়েছে যে কোনো একটি পক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে পরিকল্পিতভাবে সহিসংতা চালাচ্ছে এবং নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সুতরাং, নূন্যতম মজুরি নির্ধারণ হওয়ার পরেও শ্রমিকদেরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং তাদেরকে উস্কে দিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে নিজেদের স্বার্থে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে ওঠেপরে লেগেছে এক শ্রেণির শ্রমিক নেতা ও এনজিও যা কোনোভাবেই বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে কাম্য হতে পারেনা। যার ফলে প্রশাসনের উচিত এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশের অর্থনীতির প্রাণ গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে, নারীসহ একটি বিশাল শ্রমশক্তি। দেশ ও শ্রমিকদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তা-নাহলে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের লাভ তথা লোভের ফলে ধ্বংস হবে এদেশের পোশাক শিল্প তথা ধ্বংস হবে এদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী যাদের জীবিকার একমাত্র উৎস এই পোশাক শিল্প।
লেখক: উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া গার্মেন্টস শিল্পের অস্থিরতায় কার লাভ মত-দ্বিমত