Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যোগ্য ও ত্যাগীদের হাতেই নৌকার টিকিট

তাপস হালদার
২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১২:৩৭

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সাংবাদিক সম্মেলনে দলের মনোনয়ন প্রসঙ্গে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দিন,সেখান থেকে যে ফুলটি সুন্দর সেটি আমি বেছে নেব। নির্বাচন আসলে অনেকেরই প্রার্থী হওয়ার আকাঙ্খা থাকে। কিন্ত মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা, জনম্পৃক্ততা বিবেচনা করা হবে।’ গত ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর দলীয় ফরম বিক্রি ও জমা নেয়া হয়েছে। সেখানে মনোনয়ন প্রাপ্তির আশায় ৩৩৬২টি ফুল ফুটেছিল, সেখান থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মনোনয়ন বোর্ড ৩০০ টি ফুল বেছে নেন।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের এবারের তালিকায় রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি ক্রিকেটার, ফুটবলার, চিত্রজগতের নায়ক-নায়িকা, সংগীত শিল্পী, চিকিৎসক, আইনজীবী, আমলা, শিক্ষক, সাংবাদিক সহ নানা পেশার মানুষদের মনোনয়ন কেনার হিড়িক পড়েছিল। গড়ে একটি আসনের বিপরীতে ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ব্যতিক্রম ছিল মাত্র ১১টি আসন, এসব আসনে একজনই মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ -৩ সংসদীয় আসনের একক প্রার্থী ছিলেন। এছাড়াও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, শেখ হেলাল উদ্দিন, শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল, শেখ তন্ময়, নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, একেএম শামীম ওসমান, নাজমুল হাসান পাপন, রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক দলীয় একক প্রার্থী ছিলেন।

বেশকিছু দিন ধরে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই নয়, দেশবাসীরও গভীর আগ্রহ ছিল, কে পাচ্ছেন নৌকার টিকিট আবার কে কে নৌকার মাঝি থেকে ছিটকে পড়ছেন। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৬ নভেম্বর বিকেল ৪টায় দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব ওবায়দুল কাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন। এবারের প্রার্থী তালিকায় যেমন চমক আছে, ঠিক তেমনি মাঠের নেতাদেরও যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থার জরিপ, দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট, অতীতে আন্দোলন সংগ্রামে প্রার্থীর ভূমিকা, তৃণমূলে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা, পারিবারিক রাজনৈতিক অবস্থানসহ নানা বিষয় বিবেচনা করে প্রার্থী মনোনয়ন করা হয়েছে।

প্রার্থী ঘোষণার আগে থেকেই গুঞ্জন ছিল বর্তমান সংসদের বেশ কিছু সংসদ সদস্য মনোনয়ন বঞ্চিত হবে। গুঞ্জন সত্য হয়েছে, বর্তমান সংসদের ২৬২ জন সংসদ সদস্যদের মধ্যে ১৯০ জন পুনরায় মনোনয়ন পেলেও ৩ জন প্রতিমন্ত্রীসহ ৭২ জন সংসদ সদস্য মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। এরা বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য আগেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছিলেন। সবমিলিয়ে ১০৪ জনকে নতুনভাবে নমিনেশন দেয়া হয়েছে। এবারই প্রথম নির্বাচন করছেন ৬৫ জন প্রার্থী। তাদের মধ্যে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, নায়ক ফেরদৌস, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মূখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের সাবেক ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ। বিভিন্ন জেলায় দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতানেত্রীরা যেমন মনোনয়ন পেয়েছেন, ঠিক তেমনি তরুণ প্রজন্মের জনপ্রিয় ছাত্র ও যুব নেতারা মনোনয়ন পেয়েছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন কারণে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি আওয়ামী লীগের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর একারণেই সাংগঠনিক ভাবে দক্ষ ও জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য প্রার্থীকে বিবেচনা করা হয়েছে। সেকারণেই অনেকেই বাদ পড়েছে। নতুন মুখ এসেছে। নতুন ও পুরাতন মিলিয়েই সেরাটা বেছে নেওয়া হয়েছে। যারা বিগত দিনে বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্যের প্রতিবাদে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন, সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দীর্ঘদিন ধরেই অবদান রেখেছেন তাদেরকে মনোনয়নে প্রাধান্য দিয়েছেন। মাঠের নেতারা মনোনয়ন পাওয়ায় তৃণমূলের কর্মীরা উল্লসিত। বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা সাংগঠনিক ভাবে খুবেই দক্ষ, কর্মীদের কাছে প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বাহাউদ্দীন নাসিম, এস এম কামাল হোসেন, আহমেদ হোসেনরা গতবার মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও এবার তাদেরকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আরেকজন কর্মীবান্ধব জননেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া গতবার মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও এবার চাঁদপুর থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন।

নির্বাচনকে ঘিরে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে, সেবিষয়টি সামনে রেখে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক নেতাদেরকে বেছে নেয়া হয়েছে। ঢাকার সংসদীয় আসন গুলোর মনোনয়ন পর্যালেচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ঢাকার রাজপথ দখলে নিতে সাংগঠনিক ভাবে দক্ষ নেতাদেরকে মনোনয়ন দিয়েছেন। বিগত নির্বাচন গুলোতে শরিকদের বেশ কয়েকটি আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণে দল সেখানে সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়েছে। রাজধানীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-৮ আসন। এখানে রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, সচিবালয়, প্রেসক্লাব, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে দীর্ঘ পনের বছর ধরে আওয়ামী লীগের সাংসদ না থাকার কারণে সাংগঠনিক ভাবে আওয়ামী লীগ সেখানে সাংগঠনিক ভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। যার কারণে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট কর্মী বান্ধব নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিমকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এছাড়া জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাইনুল হাসান নিখিল, সাঈদ খোকন ও সোলায়মান সেলিমের মনোনয়নে ঢাকার রাজপথে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। সাংগঠনিক ভাবে দক্ষ নেতাদের মনোনয়ন দিয়ে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে যে, শুধুমাত্র নির্বাচনই নয়, পরবর্তী রাজনৈতিক বিষয় গুলোও বিবেচনা করা হয়েছে।

অনেকেই ধারণা করেছিল, উল্লেখযোগ্য হারে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বিশেষ করে পেশাজীবি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, সাবেক আমলা, সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী সহ সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যায়নি। বরং দলের প্রতি ত্যাগী ও জনপ্রিয় তরুণ নেতৃবৃন্দদেরকেই মনোনয়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আর জন বিছিন্ন ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ন হলেও তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। এবারের মনোনয়নে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অভিযুক্তদের বাদ দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিভিন্ন বক্তব্যে বারবার বলেছেন, তিনি কাউকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব নিবেন না, প্রার্থীকেই বিজয়ী হয়ে আসতে হবে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে সেটাই দেখা গেছে। আবার দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে দিয়েছেন। নির্বাচনকে যেন অশুভ শক্তি প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে সেজন্য প্রার্থী উন্মুক্ত রেখেছেন। যাতে করে অধিক সংখ্যক ভোটার উপস্থিত হয়। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের কেউ যাতে নির্বাচিত হতে না পারে, অপর দিকে অন্যান্য দলগুলো মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নির্বাচনকে যাতে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে। আওয়ামী লীগ শরিকদের ব্যাপারেও কঠোর মনোভাব পোষণ করেছেন। ১৪ দলের নেতারা শুধুমাত্র নৌকার উপর ভর করে বিগত ১৫ বছর ধরে নির্বাচিত হয়ে আসছে। এসব নেতারা অনেক সময়ই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাদের নির্বাচিত এলাকা সমুহে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি না থাকার কারণে দল হিসেবে আওয়ামী লীগও সেখানে দুর্বল হয়েছে। যেটা দলের জন্য খুবেই খারাপ হয়েছে। এবারের মনোনয়নে দল সেটাও যথার্থ ভাবে বিবেচনায় নিয়েছে।

আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ঘোষিত তফশিলে মনোনয়ন দাখিলের শেষ সময় ৩০ নভেম্বর আর প্রত্যাহারের তারিখ ১৭ নভেম্বর। তারপরেই জানা যাবে কে কোন প্রতীকে নির্বাচন করছে। নভেম্বরের ১ তারিখ হতে ১৭ তারিখ পর্যন্ত জোট-মহাজোটের সহ রাজনীতির অনেক মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে যাবে। তখনই চুড়ান্ত লড়াই শুরু হবে।

আওয়ামী লীগের মতো এতো বড় একটি দলের মনোনয়ন পাওয়ার মতো অনেক যোগ্য লোক আছে, কিন্তু একজনকেই তো নমিনেশন দিতে হয়। এক্ষেত্রে দলের পলিসি, সময়ের বাস্তবতা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করেই নমিনেশন দেয়া হয়। পরিস্থিতির কারণে হয়তো অনেক সময়ই শতভাগ যোগ্য ব্যক্তিকে নমিনেশন দেয়া সম্ভব হয়না। তবে এবার মাঠের নেতাদেরই বেশি হারে মূল্যায়ন করা হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতির কারণে হয়তো কেউ কেউ মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়ার কারণে সব যোগ্য প্রার্থীদেরকেই নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

তাপস হালদার মত-দ্বিমত যোগ্য ত্যাগীদের হাতেই নৌকার টিকিট


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর