Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীর বিষয়ে কানাডা নিরব কেন?

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৪:১২

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে ছিলেন বাংলাদেশসহ বিশ্বের একজন আদর্শিক এবং মানবিক নেতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বপ্নদ্রষ্টা, মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক বিশ্বের বিশ্ববন্ধু। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনে জীবনের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গিয়েছেন তিনি। বাঙালি জনগোষ্ঠীর মুক্তির স্বার্থে বঙ্গবন্ধু তার জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন কারাগারের অন্ধকারে কিন্তু অন্যায়-অত্যাচার, শোষনের কাছে মাথা নত করেন নি। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্যে বঙ্গবন্ধু যে ত্যাগ স্বীকার করেছিল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার বিপরীত প্রতিদান দিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিগুলো। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ও আত্মগোপনে থাকা বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি হচ্ছে লে. কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী (অব্যাহতি), লে. কর্নেল এএম রাশেদ চৌধুরী (অব্যাহতি), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম (অব্যাহতি), লে. কর্নেল আবদুর রশিদ (বরখাস্ত) ও রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেহ উদ্দিন। এই খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে হত্যা করেছিল বাংলাদেশের ১৮ কোটি বাঙালি জনতার স্বপ্নকে এবং হত্যা করেছিল গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বপ্নদ্রষ্টা বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের একজন নূর চৌধুরীকে সম্প্রতি কানাডার ওয়েস্টার্ন টরেন্টোতে দেখা গিয়েছে বলে সে দেশের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সিবিসি-র এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে। ১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট ভোর রাতে সেনা অফিসার নূর চৌধুরী ও তার বাহিনী বঙ্গবন্ধু ছাড়াও তার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনিদের ধানমণ্ডির বাসায় গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। টিভি চ্যানেলটির সাংবাদিক বছর সত্তরের নূরকে রাস্তায় ক্যামেরার সামনে পেয়ে যান। তার দিকে বুম বাড়িয়ে প্রশ্ন করতেই সে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গা ঢাকা দেয়। এই প্রথম তাকে প্রকাশ্যে দেখা গেল। তাদের একটি তদন্তধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। প্রতিবেদনটি নিয়ে বাংলাদেশে তুমুল শোরগোল চলছে। ওই প্রতিবেদনেই দেখানো হয়েছে নূর চৌধুরীকে কানাডার প্রশাসন আশ্রয় দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রডোর প্রশাসনের বক্তব্য, নূর চৌধুরী বাংলাদেশে ফাঁসির আসামি। মৃত্যুদ- প্রাপ্ত কোনও আসামিকে হস্তান্তরে কানাডার আপত্তি আছে। কানাডার এই অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি আপত্তি আছে ভারতেরও। ভারতে খলিস্তানি জঙ্গিদের একাংশ দেশে খুন, ধর্ষণ, মাদক পাচার, মানব পাচারের মতো গুরুতর অপরাধ করে কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও নয়া দিল্লি অপরাধীদের ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে বহু বছর যাবৎ কিন্তু ট্রুডো প্রশাসন এই ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করছে না।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণই ছিল যার মুখ্য উদ্দেশ্য। তার তৈরি সংবিধান, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নানা প্রতিষ্ঠান, তার প্রতিটি বক্তৃতা, প্রশাসনিক নির্দেশনাই প্রমাণ করে তিনি কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্বে বিশ্বাস করতেন। তার ভাবনা ও কর্মই প্রমাণ করে তিনি কতটা মানবিক ছিলেন। তিনি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন এ দেশ সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হবে। বঙ্গবন্ধু বারবারই মানুষের দুর্দশায় তাদের পাশে ছুটে গেছেন। তাদের সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তিনি তাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল জায়গায় ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়। শাসক শ্রেণি জনগণের ন্যায্য দাবি মানতে অস্বীকার করলে তিনি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।

মানুষের জন্য ভালোবাসা ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডের প্রেরণা এবং মানুষের কল্যাণই ছিল তার কর্মকা-ের লক্ষ্য। এই মানবিক মূল্যবোধই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল রাজনৈতিক সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে, যা প্রতিফলিত হয় তার বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শে, যেমন গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতন্ত্র। তিনি প্রায়ই বলতেন, তার সারা জীবনের স্বপ্ন হচ্ছে ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি’ তার এই অভিব্যক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারি সমাজ উন্নয়ন সম্পর্কে তার ধারণা ছিল কত ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর আকাক্সক্ষা খুব ছোটবেলা থেকেই আমরা বঙ্গবন্ধুর কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষ করি। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন তিনি একই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি এবং সমাজসেবার কাজে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। তার রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দরিদ্র, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষা। যার ফলে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে বঙ্গবন্ধু সকলের নিকট একজন মানবিক ও আদর্শিক নেতা হিসেবে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।

অথচ অত্যন্ত মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ছবক দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিশ্বে স্বীকৃত ও পরিচিত মানবিক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের আশ্রয় দিয়ে আসছে বছরের পর বছর। তারা যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে সে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার তাদের নিজেদের দেশেই পদদলিত হচ্ছে। বিশ্বনেতা ও বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন খুনি কানাডায় অবস্থান করছে অথচ কানাডার প্রশাসন সেখানে নীরব ভুমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন মানবিক বিশ্বনেতার খুনি নূর চৌধুরীর ব্যাপারে কানাডা সরকারের এমন নীরব ভুমিকা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার শামিল। বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরীকে আশ্রয় দিয়ে কানাডা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী কাজ করছেন। বিশ্বনেতার আত্মস্বীকৃত একজন খুনি কখনো বিশ্বের কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আশ্রয় পেতে পারেনা। নূর চৌধুরীর মতো একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিরোধী কাজ করছে যা কোনোভাবেই বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নিকট কাম্য হতে পারেনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শুধু মানবিক নয় বরং একজন অসাম্প্রদায়িক নেতা ছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই, শুরু থেকেই তার অবস্থান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ১৯৪৬-৪৭ সালে যখন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং পাকিস্তান সৃষ্টি নিয়ে নানা অসঙ্গতির সৃষ্টি হলো, সেই সময় বঙ্গবন্ধু তার অবস্থা সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে উল্লেখ করেন, ‘ভারতবর্ষে মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষে হিন্দুরাও মুসলমানকে ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে।

সদ্যস্বাধীন একটা দেশের প্রধান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রধানরা তাকে মানবতা ও মুক্তির দূত হিসেবে গণ্য করতেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে কুচক্রীরা। এই খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে বিশ্বসম্প্রদায়। বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের খবর প্রকাশ হওয়ার পর কেঁপে ওঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। মুজিবহীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেও পারছিল না কেউ, বঙ্গবন্ধুকে দিয়েই তারা বাংলাদেশকে চিনেছিল। তাই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছে, ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনোই জন্ম নিত না।’ দ্য টাইমস অব লন্ডন-এর ১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট সংখ্যায় বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।’ পশ্চিম জার্মানির পত্রিকায় বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনি জনগণের কাছে এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, লুইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমিই রাষ্ট্র। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনির কিসিঞ্জার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো তেজি এবং গতিশীল নেতা আগামী বিশ বছরের মধ্যে এশিয়া মহাদেশে আর পাওয়া যাবে না।

সুতরাং এমন অদ্বিতীয় এবং অনন্য একজন বিশ্বনেতা তথা বিশ্ববন্ধু, স্বাধীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি নূর চৌধুরীকে নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে কানাডা নিজেদেরকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের রক্ষাকর্তা হিসেবে দাবি করা নির্ঘাত উপহাস ছাড়া অন্য কিছু নয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি নূর চৌধুরীর ব্যাপারে কানাডা সরকারের এমন নীরব ভুমিকা নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নিকট হতাশাজনক। এমতাবস্থায়, কানাডা সরকারের উচিত স্বাধীন বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে লিখিত সংবিধান অনুযায়ী ফাঁসির আসামী নূর চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চর্চা অব্যাহত রাখতে সহায়তা করা। অন্যথায়, বিশ্বের গণতন্ত্রকামী দেশ ও জনগণের নিকট গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে কানাডার নিছক এই অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ধরা দিবে।

লেখক: উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব), বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া টরোন্টোতে বঙ্গবন্ধুর খুনী নূর চৌধুরীর বিষয়ে কানাডা নিরব কেন? মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর