সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন ও সরকার বদ্ধপরিকর
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৬
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ, অবাধ, ভীতিহীন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করার জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এবং বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণ সহায়তা দেওয়ার সব ব্যবস্থা নিয়েছে। একইসাথে এটিও লক্ষণীয় যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনও সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন এবং করছেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বর্তমান নির্বাচনকালীন গণতান্ত্রিক সরকারের উপর একারণে সব মহলের আস্থা রাখা যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গত ১৫ নভেম্বর বুধবার ২০২৩ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সেদিন সন্ধ্যায় বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে ভোটের তারিখ ঘোষণা করেন সিইসি। তফসিল অনুযায়ী ভোট হবে আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়ন পত্র জমার শেষ তারিখ ছিল ৩০ নভেম্বর। মনোনয়ন পত্র যাচাই-বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর। এ দিন থেকেই প্রার্থীরা প্রচার শুরু করতে পারবেন। নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হবে ৫ জানুয়ারি সকালে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমার জন্য ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। এসময়সীমার মধ্যে সারা দেশে ৩০০ সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্রসহ মোট ২ হাজার ৭১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দিলেও বাছাইয়ে ৭৩০ জন বাদ পড়েন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৪ জন এবং জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির অন্তত ৩০ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। বাছাইয়ে বাদ পড়া বাকিরা অন্যান্য দলের।
নির্বাচনী প্রচারের জন্য ১৯ দিন সময় রয়েছে। নিয়মানুযায়ী ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার শেষ করতে হয়। সেই হিসেবে ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটের প্রচার চালানোর সুযোগ থাকবে। সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখ মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে পাঠানো ইসির চিঠিতে বলা হয়েছে, নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে, ভোটাররা ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন, এমন কোনো সভা-সমাবেশ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন থেকে সবাইকে বিরত রাখা বাঞ্ছনীয়।
১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। ১৮ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা। নির্বাচনী প্রচারণার কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ১৮ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগপর্যন্ত ভোটের প্রচারের বাইরে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি আয়োজনের অনুমতি না দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই সময়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হতে পারবে না। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোট গ্রহণের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার পথে সমস্ত প্রকারের প্রতিবন্ধকতা অপসারণের লক্ষ্যে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অতীতে দেখা গেছে নির্বাচন বর্জনকারী গোষ্ঠী প্রকৃতপক্ষে সহিংসতার মাধ্যমে দেশটাকে খুবলে খেতে উদ্যত হয়ে থাকে। এই অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনে বাধা দূর করতে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সঠিক বলেই পর্যবেক্ষক মহলের বিশ্বাস।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান তথা ভোট গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা নির্বাচন বিরোধী গোষ্ঠীর আগুন সন্ত্রাস। বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালিত এইসব আগুন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধের প্রয়োজনীয়তা সর্বত্র অনুভূত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে “নির্বাচনী প্রচারণা” ছাড়া অন্যকোন রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নিমিত্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়ে দেয়া নির্বাচন কমিশনের চিঠি যথার্থ।
বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠী নির্বাচন প্রতিহত করার নামে সারাদেশে জ্বালাও-পোড়াও কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তর জানাচ্ছে, গত ২৮ অক্টোবর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২৪১টি যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। একই সময়ে ৩৭৬টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরও জানা যায়, শুধু রাজধানীতে ১২৩টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যে গোষ্ঠী বর্তমানে জ্বালাও-পোড়াও চালাচ্ছে তারা অতীতেও এধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এইসব সহিংস কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য আইন সঙ্গত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। সেহিসেবে নির্বাচন কমিশনের পদক্ষেপ সঠিক। আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগ ছাড়া আগুন সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব নয়।
আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার তাগিদ সর্বত্র। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারের প্রতিটি অফিস এবং নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তি সাহসিকতা ও সততার সঙ্গে যার যার দায়িত্ব পালন করলেই কেবল নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বাংলাদেশের বিশেষত: সামরিক শাসন এবং সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর শাসনামলে অতীতে অনুষ্ঠিত প্রশ্নের উদ্রেকারী নির্বাচনসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
নির্বাচন এবং অন্যান্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া একটি দেশের শাসন প্রক্রিয়ার মানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদী গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে এগিয়ে নেয়ার জন্য অপরিহার্য । বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে সংজ্ঞায়িত করার সবচেয়ে মৌলিক নীতি হল যে সেগুলি অবশ্যই জনগণের ইচ্ছার স্বাধীন অভিব্যক্তি প্রতিফলিত করবে। সেই হিসাবে নিকট অতীতে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল। সেই নির্বাচনে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক অযোগ্য ঘোষিত জামায়াত ব্যতীত সংসদীয় রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল প্রায় সকল রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করেছিল। এইসব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি এবং অন্যান্যরা। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যেকোন মানদন্ডে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জনগণের স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলনকারী নির্বাচন হিসেবে গণ্য করা যায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৬৬টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছিলেন। সেই নির্বাচনে ২২ টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ০৭ আসন পেয়ে এককভাবে নির্বাচনে তৃতীয় স্থান লাভ করেছিল।
অতীতে এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলোতেও সহিংসতা ও কারচুপির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনের আগে, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনের পরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসময়গুলোতে বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার উপর চরম আঘাত নেমে আসতে দেখা গেছে। আবার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুক্ষ্ণ কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর সারা বাংলাদেশব্যাপী হামলা ও রক্তপাত ঘটিয়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের লোপ্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। বিএনপি-জামায়াত জোট নিজেরা বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোকে কলুষিত করে এখন আবার সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মত সহিংসতা সৃষ্টি করছে। একাজে তারা বহি:শক্তির মদত পাচ্ছে। এমতাবস্থায়, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দেশের আপামর জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা নির্বাচন কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। এর জন্য প্রশাসন, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ সহায়তা প্রত্যাশিত। গত ২৯ নভেম্বর ২০২৩ নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় কর্মশালার উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল পুনরায় আসন্ন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার অহ্বান জানিয়েছেন।
দেশের অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎসহ প্রায় সবকিছু রক্ষা করতে হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, ও শান্তিপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তাই গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর তা করার জন্য বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ,ঢাকা। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী মত-দ্বিমত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন ও সরকার বদ্ধপরিকর