কতকাল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে সাংবাদিক মানিক সাহার হত্যাকারীরা?
১৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৪১
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উচ্চারিত এক অকুতোভয় সাংবাদিকের নাম মানিক সাহা। তিনি একাধারে মানবাধিকারকর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। দেশের দক্ষিণ -পূর্বাঞ্চলে তার নাম জানেন না এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবের অদূরে ছোট মির্জাপুর এলাকায় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের পৈশাচিক বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই জীবনপ্রদীপ নিভে যায় সময়ের এই সাহসী সন্তানের। তার মৃত্যুতে দেশবাসী হারায় একজন দেশপ্রেমিক নাগরিককে। যার চিন্তা-চেতনা আর ভাবনার পুরোটাই জুড়ে ছিল দেশ, মুক্তিযুদ্ধ আর সাধারণ জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত মুক্তচিন্তার অধিকারী মানিক সাহা আন্তর্জাতিক সততা পুরস্কারে ভূষিত দেশের একমাত্র কলমসৈনিক ও কণ্ঠযোদ্ধা। মৃত্যুকালে দৈনিক সংবাদ ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার খুলনার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এবং বিবিসি বাংলার খণ্ডকালীন সংবাদদাতা ছিলেন মানিক সাহা। শুধুমাত্র ভালো সাংবাদিকই নয়, সাংবাদিকদের নেতাও ছিলেন তিনি। খুলনা প্রেসক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মানিক সাহা। ছিলেন দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল গণমাধ্যমকর্মীদের পিতৃতূল্য অভিভাবক। দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার মাধ্যম একুশে টেলিভিশনের যাত্রালগ্ন থেকে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এর খুলনা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন মানিক সাহা।
মানিক সাহার পরিচয় শুধুমাত্র গণমাধ্যম জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের সাংবাদিক সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিন্দা ও প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছিল, তা দেখে তখন অনেক সাধারণ মানুষ নিশ্চিত হন তিনি শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না; তার পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। মৃত্যুকালে মানিক সাহা একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক ছাড়াও বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, খুলনা চ্যাপ্টারের সভাপতিও ছিলেন।
মানিক সাহার সাহসিকতা ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্ররাজনীতি থেকে শ্রেণি বৈষম্যের বিরূদ্ধে লড়াইয়ে দীক্ষিত মানিক সাহা নিজেকে বহুমুখী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ও ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন ভূলন্ঠিত, বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেয়াও যখন ভয়ের, সেই প্রতিকূল শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এক দুঃসাহসিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখলবাজদের অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরূদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক অভিনব কর্মসূচি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। সারাদেশে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত পোস্টার লাগাতে শুরু করেছিল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এক রাতে খুলনার বি এল কলেজ চত্বরে সেই পোস্টার লাগানোর সময় জেনারেল জিয়ার অনুসারী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মানিক সাহাকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর নির্মম দৈহিক নির্যাতন ছাড়াও সামরিক আদালতের বিচারে ২২ মাস কারাদণ্ড হয় তাঁর। জেলখানায় বসেই স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন মানিক সাহা। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ আমলেও গ্রেপ্তার হয়ে আরেক দফা নির্মম নির্যাতন ও দীর্ঘ কারাবাসের শিকার হয়েছিলেন মানিক সাহা। শাসক ও শোষকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাহসিকতার সাথে আদর্শের পথে অবিচল ছিলেন মানিক সাহা।
অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মানিক সাহা দারিদ্র্যকে পায়ে মাড়িয়ে স্নাতকোত্তর এবং আইন শাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। অর্জন করেন বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদ ও খুলনা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ। কিন্তু আইন ব্যবসায় না গিয়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন সাধারণ মানুষের শোষণ-বঞ্চনা ও ন্যায্য অধিকারের কথা তুলে ধরতে সাংবাদিকতাকে। ঐ অঞ্চলে সাংবাদিকতা পেশা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও পেশা নির্বাচনে সাংবাদিকতাকেই গুরুত্ব দেন তিনি। দীর্ঘ দুই দশকের পেশাগত জীবনে তার কলমে গণমানুষের অধিকারের কথাই বার বার ফুটিয়ে তুলেছেন মানিক সাহা তাঁর অপ্রিয় ও সাহসী উচ্চারণে।
ফসলি জমিতে জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে লোনা পানি ঢুকিয়ে পরিবেশবিনাশী চিংড়ি চাষের বিরূদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন এই নির্লোভ মানুষটি। বিত্তবান ও প্রভাবশালী চিংড়িঘের মালিকদের প্রলোভন ও রক্তচক্ষু তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি কখনো।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের পৈশাচিক নির্যাতনের কাহিনি বিবিসি রেডিওতে মানিক সাহার কণ্ঠে শুনেছি কতবার!!
খুলনায় জনশ্রুতি আছে তৎকালীন বিএনপি – জামায়াত সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। খুলনার বিএনপি ও জামায়াতের তৎকালীন দুই সাংসদ, বাগেরহাটের বিএনপিদলীয় এক সাংসদ ও খুলনার জামায়াতপন্থী এক সাংবাদিক ছাড়াও খুলনা বিভাগের তৎকালীন এক মন্ত্রী এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল।
মানিক সাহা তার সতীর্থ সাংবাদিক ও সাংবাদিকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ যখন নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত হয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে ন্যায্য প্রতিকার পায় না, ন্যায়বিচারের আশায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে ব্যর্থ হয়, তখন সাংবাদিকরাই হয়ে ওঠেন তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। তাই সাংবাদিকদের সেভাবেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’ সাংবাদিকতার মহান পেশায় যাত্রা শুরু থেকে আমৃত্যু সেই দায়িত্বশীলতার পরিচয়ই দিয়ে গেছেন সততার পথে, চেতনার পথে অবিচল শ্রদ্ধাভাজন মানিক সাহা।
বহু গুণে গুণান্বিত একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক মানিক সাহা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও শিশু সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কমরেড রতন সেন পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক, উদীচীর খুলনা জেলা সংসদের সহসভাপতি, খেলাঘর-খুলনা জেলা কমিটির উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষা অনুরাগী মানিক সাহা, শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অরতীর্থ বিদ্যাপীঠের সহসভাপতি এবং খুলনার ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাউথ হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাডেমিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্বে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। প্রিয়ভাজন মানিক সাহার হাতেগড়া অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক আজ আলো ছড়াচ্ছন জাতীয় পর্যায়ে।
মানিক সাহা হত্যার ১২ বছর পর ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর খুলনা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং জেলা ও দায়রা জজ এম এ রব হাওলাদার এ চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১১ জন আসামির ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
জনশ্রতি রয়েছে পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্রে হত্যার পরিকল্পনাকারী, অর্থের জোগানদাতা, তাদের পৃষ্ঠপোষক ও ভাড়াটিয়া খুনিদের নাম ছিল না। হত্যার সাথে জড়িত রাঘব বোয়ালরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও গণমানুষের পক্ষে সবসময় সোচ্চার আমৃত্যু সংগ্রামী মানিক সাহার প্রকৃত হত্যাকারীরা খোলা আকাশে, মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াবে এটা ভাবাও অনেক কষ্টের! তাই তার ২০ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আবারও দাবি উঠেছে পুনরায় তদন্ত করে মানিক সাহা হত্যার পৃষ্ঠপোষক ও পরিকল্পনাকারীদের বিচার করা হোক। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী আওয়ামী লীগ সরকার বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের ব্যক্তিস্বার্থে যেনো জনবান্ধব সরকারের এই ভাবমূর্তি নষ্ট না হয় এমন প্রত্যাশা দেশবাসীর।
লেখক: সহ সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য
সারাবাংলা/এসবিডিই
কতকাল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে সাংবাদিক মানিক সাহার হত্যাকারীরা? মত-দ্বিমত মানিক লাল ঘোষ