তীব্র তাপপ্রবাহ- কারণ, প্রভাব ও সমাধান
২২ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:২৬
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে অস্বাভাবিকভাবে তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও উপরে উঠেছে, যা স্বাভাবিক তাপমাত্রার অনেক বেশি। এই অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহ মানুষের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে, কৃষিক্ষেত্রে ক্ষতি করছে, জলপ্রবাহের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা সৃষ্টি করছে।
এই অতি তীব্র তাপপ্রবাহের বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্যাসগুলো সূর্যের তাপ বন্দি করে রাখে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এল নিনো হল প্রশান্ত মহাসাগরের একটি আবহাওয়াজনিত ঘটনা যা বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটায়। এটি বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির একটি কারণ হিসেবে কাজ করছে।
বন উজাড়ের ফলে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের বৃহৎ শহরগুলোতে অপরিকল্পিত নগরায়ন, যানবাহনের ধোঁয়া, এবং কলকারখানার নির্গমন বায়ু দূষণ বৃদ্ধি করছে। এই দূষণ তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আরও অবদান রাখছে।
এই অতি তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব ব্যাপক ও বিরূপ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তীব্র তাপ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন, হৃদরোগ, কিডনি রোগ এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।
তীব্র তাপ ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। তীব্র তাপের ফলে পুকুর, খাল, নদ-নদী ও জলাশয়ের পানি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পানিপ্রবাহের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তীব্র তাপের কারণে বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়া, বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যা এবং পর্যটন শিল্পে মন্দা এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে পরিবেশের উপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে, বনভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং মরুভূমিকরণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই অতি তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী উভয় ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন যেমন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলা।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবিলায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি করে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করা সম্ভব।
পানি সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও অপচয় রোধ করে পানি সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
নগরায়ন পরিকল্পিতভাবে করতে হবে, যাতে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
মানুষকে তীব্র তাপপ্রবাহের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং তাদের সাবধানতার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করতে হবে।
সরকারকে তাপপ্রবাহের শিকার মানুষদের সহায়তা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, শুষ্ক খাবার ও পানি বিতরণ, এবং চিকিৎসা সহায়তা প্রদান।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বৃদ্ধি এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো। বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি এবং বন উজাড় রোধ করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো। তাপপ্রবাহের শিকার মানুষদের সহায়তা করার জন্য দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা স্থাপন করা।
বেসরকারিভাবেও উদ্যোগ নিতে হবে যেমন: পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। পানির অপচয় রোধ করা। তাপপ্রবাহের শিকার মানুষদের সাহায্য করা।
তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ব্যক্তিগতভাবেও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা, হালকা পোশাক পরা, বাইরে বের হওয়ার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা, এবং নিয়মিত শরীর ঠান্ডা রাখা।
বাংলাদেশে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ একটি জরুরী সমস্যা যা দ্রুত সমাধানের দাবি করে। এই সমস্যার সমাধানে সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং সাধারণ মানুষ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পাশাপাশি, স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করেও আমরা এই সমস্যার প্রভাব মোকাবিলা করতে পারি।
আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই অতি তীব্র তাপপ্রবাহের সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমাদের পরিবেশের প্রতি সচেতন হতে হবে এবং টেকসই জীবনযাপন করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
অতি তীব্র তাপপ্রবাহ: কারণ প্রভাব ও সমাধান ড. মতিউর রহমান মত-দ্বিমত