Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি: গড় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড

সৈয়দ ফারুক হোসেন
২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:৪০

দেশের প্রায় সব অঞ্চলের ওপর দিয়ে বইছে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রচন্ড গরমে নাকাল দেশবাসী। কয়েকদিন ধরেই বয়ে চলছে তাপদাহ। গরমে দীর্ঘ সময় রোদে থাকার ফলে হিটস্ট্রোক হয়ে অসুস্থ হয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকেই। হিটস্ট্রোকের লক্ষণ শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বেড়ে যাওয়া।গরমে অচেতন হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা, তীব্র মাথা ব্যথা, ঘাম কমে যাও, ত্বক গরম ও শুষ্ক হয়ে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা ও পেশিতে টান অনুভব করা, বমি হওয়া। এর ফলে ঘাম বন্ধ হয়ে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। হিটস্ট্রোকের কারনে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনই দায়ী।সারা পৃথিবীকেই এর ফলভোগ করতে হবে।ভয়াবহ গরমের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবেই আবহাওয়া দ্রুত এমন দুর্যোগপূর্ণ হচ্ছে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি।

বিজ্ঞাপন

সারাদেশে তীব্র তাপদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। সকাল থেকেই তাপমাত্রা অল্প অল্প করে বাড়তে শুরু করে। রোদের তীব্রতা এতটাই বেশি যে বাইরে কাজে বের হয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। একটু স্বস্তি পেতে অনেকে আশ্রয় নিচ্ছেন পার্কে কিংবা রাস্তার পাশে গাছের ছায়ায়। রোদের তাপে গলছে সড়কের পিচ। দিনে তীব্র গরমের পর রাতেও নেই স্বস্তি । রাতেও প্রচন্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর ফলে নানারকম সমস্যার সঙ্গে বাড়ছে তাপমাত্রাও।দিন দিন বাড়তে থাকা জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে সংকটে পড়া ঢাকার তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে বেশি হচ্ছে। ঢাকায় বাস করেন প্রায় ৪ কোটি ৪২ লাখ মানুষ। তার ওপর গ্রাম থেকে এসে মানুষ প্রতিনিয়তই ঢাকায় ভিড় জমাচ্ছেন।এ সমস্যা সব থেকে বেশি হচ্ছে ঢাকার বিভিন্ন বস্তি অঞ্চলে।একদিকে বাড়ছে মানুষ অন্যদিকে ঢাকা পরিণত হচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গলে। সেই সঙ্গে ঢাকায় কমছে সবুজ। .

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও বস্তিগুলোতে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও খাবার পানির ঘাটতি রয়েছে। সেখানকার ঘরগুলো তৈরি ধাতু বা টিন দিয়ে। গরমে সেগুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অন্যদিকে এই সকল অঞ্চলে বিদ্যুতের সমস্যা দেখা দিলে তখন পরিস্থিতি জটিলতার ধারণ করে। দেশজুড়ে তীব্রদাহ দাবদাহ কোন ভাবেই কমছে না। গরমে দীর্ঘ সময় রোদে থাকার ফলে হিটস্ট্রোক হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই। শিশু ও বয়স্কদের জন্য এই ঝুঁকি আরো বেশি। এই পরিস্থিতিতে শরীরে পানিশূন্যতা এড়াতে অতিরিক্ত পানি ও শরবত পান করা উত্তম।স্যালাইন পানিতে থাকা সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও চিনি শরীর সজীব রাখতে বিশেষভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে । দীর্ঘ সময় গরমে থাকলে গ্রীষ্মকালীন ফল দিয়ে তৈরি তাজা জুস পান করা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। বাইরে তাপমাত্রা যাই হোক না কেন আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা প্রায় স্থির রাখতে সক্ষম। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলে তখন হিট স্ট্রোকের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। দেশের ঋতু কাল এখন ওলোটপালট হয়ে গিয়েছে।তীব্র এই তাপদাহ থেকে মুক্তি মিলবে ভারি বর্ষণ হলে। সারাদিন কড়া রোদের সঙ্গে প্রচণ্ড ভাপসা গরমে সর্দি, কাশি, জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এ অবস্থায় জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকা উত্তম।

এদিকে গরমের কারণে শারীরিক নানা সমস্যা বাড়ছে। গরমের কারণে বাড়ছে নানা গার্হস্থ্য সমস্যাও। পাশাপাশি সঙ্গে ঢাকার বাতাসের মান কমে যাওয়ার সঙ্গে নানা রকম দূষণও বাড়ছে। ঢাকা এবং আশপাশের এলাকায় তাপমাত্রা কমাতে আরও বেশি গাছ লাগানো জরুরি। বর্তমানের এই কঠিন তাপদাহ পরিস্থিতি থেকে সবাইকে সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত শরীরের যতœ নেওয়ার পাশাপাশি হিটস্টক বিষয়ে সচেতনতার আরও বৃদ্ধি করতে হবে। প্রকৃতিতে এত তাপদাহের মূল কারণ হলো জলবায়ুর বৈপ্লবিক পরিবর্তন । বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পুরো পৃথিবীর প্রাকৃতিক চরিত্রেও পরিবর্তন এসেছে। ঢাকার বর্তমান তাপপ্রবাহ পরিস্থিতি দীর্ঘদিনের পরিবেশ ধ্বংসের একটি ফলাফল। পরিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ু অনুযায়ী ঢাকা কতটা বসবাস উপযোগী সেটিই এখন মূল আলোচনা। বিগত কয়েক বছরে সবচেয়ে বায়ুদূষণের নগর হিসেবে রেকর্ড করেছে ঢাকা। এখন রেকর্ড তাপমাত্রা যেন নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। যেখানে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার জন্য লড়াই চলছে, ঠিক একই সময়ে গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপদাহের এ বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরগুলোয় দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, যার কারণে সব সময়ই গরম অনুভূত হবে। নগরাঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা নয় বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা।

জলবায়ু ও পরিবেশগত পরিবর্তন ছাড়াও জনসংখ্যা ও তার ঘনত্ব এবং মানুষের কর্মকান্ডের ওপর নির্ভর করে কোন স্থানের তাপমাত্রা কেমন হবে। তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনা। প্রধানত বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এ তিন কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। আমাদেরকে এখনই সতর্ক হতে হবে এবং পরিবেশ দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে পুরো পৃথিবীকে। বর্তমানে বাংলাদেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। জলবায়ুর পরিবর্তন ও এর প্রকৃত বা সম্ভাব্য প্রভাবের সাথে প্রাকৃতিক বা মানুষের জীবনাচরণ পরির্তনের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া যাতে ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায় বা সম্ভাবনার যথার্থ ব্যবহার করা যায়। বিশ্ব উষ্ণায়ন হলো জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিশেষ ঘটনা।

মানুষ যেভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো অব্যাহত রেখেছে, তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ বছর বা আগামী বছর বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হতে পারে। এটি মূলত খরা পরিস্থিতি। মানুষের কর্মকান্ড পৃথিবীকে এমনভাবে পরিবর্তন করেছে, যা ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমাতে গত কয়েক দশক ধরে অনেক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও উন্নত দেশগুলোতে ক্লিন ফুয়েলের ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সব দেশ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ তার অন্যতম। মানুষের প্রভাবে পরিবেশের ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের জন্য মনুষ্যসৃষ্টি অনেক কারণকেই দায়ী করা হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতির ওপর নানাভাবে খবরদারি করছে।

প্রাচীনকালে মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। মানুষ যখন থেকে সভ্যতার সংস্পর্শে আসে তখন থেকেই প্রকৃতির ওপর আঘাত হানতে শিখে। পৃথিবীর জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় আমাদের জরুরিভাবে সাহসী এবং অধিকতর শক্তিশালী ব্যবস্থা নিতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, নগরায়ন ও অবাধে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি টিলা ও পাহাড় কাটা, নদী ভরাট, নগরের অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন, এসব কিছুই সুস্থ পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। সচেতনতার অভাবে আমাদের পরিবেশ আজ বসবাসের অযোগ্য। কলকারখানা ও যানবাহনের বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর গ্যাস, ইটের ভাটায় ধোঁয়া, শিল্পে বিষাক্ত বর্জ্য প্রভৃতির কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অবাধে বৃক্ষ নিধনে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যাচ্ছে দ্রুত, বাড়ছে সিসা, বিলুপ্ত হচ্ছে নানা প্রজাতির পক্ষী ও বন্যপ্রাণী। নদীতে পানি দূষণে মাছের সংখ্যাও কমে আসছেসহ বিভিন্ন কারণে পরিবেশ হচ্ছে দূষিত হারিয়ে ফেলছে এর ভারসাম্য।

পরিবেশ সমস্যার সমাধান করতে হলে অনবরত বনায়ন করতে হবে। আমরা সবাই মিলে যদি বাংলাদেশের প্রকৃতিকে সবুজ দিয়ে সাজিয়ে তুলি প্রকৃতি-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি তাহলে এভাবে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে আমরাও বাঁচব। আমাদের এখান বেশি বেশি করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করাতে হবে। শুধু গাছ লাগালেই হবে না। সেগুলোর উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। নগরে বনায়ন করা খুব জরুরি। এখানে যে ফাঁকা এবং পরিত্যক্ত জায়গাগুলো আগে সেখানে সবুজায়ন করার প্রতি বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের আরও অনেক পার্ক এবং সবুজে ঘেরা জায়গা দরকার। এতে করে তাপমাত্রা যেমন কমবে তেমনই পাখিসহ নানা প্রাণীও ফিরে পাবে স্বাচ্ছন্দ জীবন। তীব্র দাবদাহে আমরা নিজেরা যদি সচেতন থাকি তাহলে কিন্তু অনেকটাই নিরাপত্তা পেতে পারি।

লেখক: রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর

সারাবাংলা/এসবিডিই

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি: গড় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড মত-দ্বিমত সৈয়দ ফারুক হোসেন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর