দুর্গম পথের নির্ভীক যাত্রী
১৭ মে ২০২৪ ১৭:৫৬
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে নির্মম নিশংসভাবে হত্যা করার পর খুনিদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষাকারী সামরিক শাসক জিয়া তার শাসনামলের ছয়টি বছর তাকে দেশেই আসতে দেয়নি। কিন্তু ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার দেশে আগমন করার পর থেকেই অমানিশার অন্ধকার কাটতে শুরু করেছিল। নতুন করে বাংলাদেশের মানুষ আবার আশায় বুক বেঁধেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল বাংলাদেশের মানুষ। সেই সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে বারবার মৃত্যুর মুখে পড়তে হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে প্রতিবারই তিনি বেঁচে গেছেন। শেখ হাসিনা যখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন তখন তার বয়স ছিল চৌত্রিশ। আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো বয়স সেটা আক্ষরিক অর্থেই ছিল না। তারপরে তখনকার পরিবেশ ছিল খুবই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। একদিকে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের দুঃশাসন কাল অন্যদিকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় জাতির পিতার খুনিদের আস্ফালন। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পথ ছিল কণ্টকময়। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনাকে সব সময় ধাওয়া করে গেছে কোনো না কোনো বুলেট বোমা। কিন্তু ভরসার জায়গা ছিল দেশের মানুষ ও তাদের অফুরন্ত ভালোবাসা এবং আল্লাহপাকের অশেষ রহমত। মানুষের ভালোবাসাকে সম্মান করেই পনেরই আগস্টের বিয়োগান্তক বেদনাকে বুকে ধারণ করে শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই-সংগ্রাম করে গেছেন শেখ হাসিনা। তার প্রাথমিক পরিসমাপ্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই পথ পাড়ি দিতে শেখ হাসিনাকে ’৭৫-এর খুনিদের বিরামহীন ঔদ্ধত্য, পাশাপাশি দেশি-বিদেশি চক্রান্ত, মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে জর্জরিত আওয়ামী লীগকে জনগণের আকাংক্ষার প্রতীকে পরিণত করতে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। সারা দেশের আনাচে-কানাচে প্রতিটি জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে সফর করেছেন। এই সময় ’৭১ ও ’৭৫ খুনিদেরকে পরাজিত করতে এবং সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তাকে রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে বারবার দমন করতে চেয়েছে, হত্যা করতে চেয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দুর্নিবার সাহস ও মানুষের ভালোবাসা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তিনি বিজয়ী হয়েছেন।
শেখ হাসিনার এই দুর্গম চলার পথ নিয়ে লেখা বা তাকে মূল্যায়ন করা স্বল্পপরিসরে অনেক কঠিন। সমসাময়িক কালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনের অন্যতম প্রধান ও প্রবীণ রাজনীতিকের নাম শেখ হাসিনা। শুধু আট বারের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য ও তিনবারের বিরোধী দলের নেতা এবং পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী নন, একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে টানা চল্লিশ বছরের অধিক সময় ধরে পথচলার পাশাপাশি প্রায় দুই দশকের বেশি সময়ে সফলভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি শুধু এই উপমহাদেশে একজন সিনিয়র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। একটি দেশের প্রতিষ্ঠাতার কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার জন্য যেমন গৌরব ও সম্মানের। তেমনি পিতার আদর্শ, সততা, সাহস নিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন পথ চলাও বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ সবকিছুতেই মানুষের প্রত্যাশার পরিমাণ থাকে বেশি। বঙ্গবন্ধু সিকি শতাব্দী ধরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে জেল জুলুম নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করে এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন সার্বভৌম করে দিয়ে গেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের যে ভিত্তিমূল তিনি তৈরি করে গিয়েছিলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেই অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদন করার জন্য নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন তা এখনও অব্যাহত আছে। সেই সংগ্রামের প্রথম পর্যায়ের সামরিক জান্তা জিয়া-এরশাদের দুঃশাসনকে মোকাবিলা করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নেতৃত্ব এখনও দিয়ে চলেছেন। এই যে লম্বা পথচলা তা একজন পোড় খাওয়া দেশপ্রেমিক রাজনীতিকেরই পরিচয় বহন করে। তিনি পিতার আদর্শ বহন করে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে একটি উন্নত সমৃদ্ধশালী দেশ নির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার এই কাজের শক্তির উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিই যে তার সব কর্ম এবং উদ্দীপনার সাহস ও প্রেরণা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি।
শেখ হাসিনার বড় গুণ হচ্ছে সততা এবং সাহস। যা তিনি তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন। তিনি দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ তিনি সব সময় জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো অসীম সাহস তাকে তার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত প্রতিকূল পরিবেশ পাড়ি দিতে সহায়তা করেছে। পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই দয়ালু ও মানুষকে ভালোবাসার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী। তিনি যেমন প্রান্তিক মানুষের দুঃখে নিজে কষ্ট পান ঠিক তেমনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নানা কষ্ট দুঃখের ভাগীদার হয়ে মমতার হাত নিয়ে পাশে দাঁড়ান। তিনি জীবনযাপনে যেমন সাধারণ, ব্যক্তিত্বে নেতৃত্বে তেমনই অসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর মতোই গ্রামের খেটেখাওয়া অসহায় নিরীহ মানুষকে অবলীলায় বুকে টেনে নিতে পারেন। একইভাবে দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সমানভাবে অন্তর দিয়ে ভালোবাসেন, সহায়তা করে থাকেন, তাদের সাহস জোগান। কী সরকারি দল, কী বিরোধীদল কতশত পরিবারকে যে নীরবে-নিভৃতে শেখ হাসিনা তাদের সংসার খরচ, পড়াশোনার খরচ, চিকিৎসার খরচ বহন করেন তা হয়তো আমরা দেশের অনেক মানুষই জানি না। বঙ্গবন্ধু মানুষকে ভালোবাসতেন। সাধারণ মানুষের ভালোবাসাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। তাঁর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনাও মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় আজও দেশের মানুষের জন্য নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের এই ভালোবাসার কাছে সব অপশক্তি আজ পরাজিত।
১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেষ করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল বিএনপি সরকার। কিন্তু মানুষের ভালোবাসায় বেঁচে গিয়ে তিনি তার পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেশকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তা একদিন পূরণ হবেই। নানা সময়ে দলের লোকদের দ্বারাও বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। অনেকেই দুঃসময়ে বেইমানি করে দূরে সরে গেছে। আবার ভুল বুঝে ফিরেও এসেছেন। মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়া নেতাদেরও ক্ষমা করে দলে জায়গা দিয়েছেন। আবার তার নিজের সঙ্গেও যারা বেইমানি করেছেন তাদেরকেও ক্ষমা করে কাছে টেনে নিয়েছেন। নিজেই বলেছেন, তিনি নীলকণ্ঠী, বিষ খেয়েও হজম করতে পারেন। এটাও তার নেতৃত্বের একটি বিরাট গুণ। এ যেন দুর্গম পথের এক নির্ভীক যাত্রী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন দেশের মানুষের কাছে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে জাতির পিতা বা বঙ্গবন্ধু হিসেবেই অধিক আপন বা শ্রদ্ধেয়। তেমনই শেখ হাসিনাও প্রধানমন্ত্রীর আসনকে টপকিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বে এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন এটাই শেখ হাসিনার অর্জন। কন্যা হিসেবে তিনি সফল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনেছেন এবং তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশকে অনেক উন্নত ও সমৃদ্ধ করেছেন। মা হিসেবেও গর্ব করার মতো একজন মা। যার দুই সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুসন্তান রূপে গড়ে তুলেছেন, যাদের কিনা ক্ষমতা ও বিত্ত-বৈভব স্পর্শ করতে পারেনি। একইভাবে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করাও শেখ হাসিনার মতো নেতার পক্ষেই কেবল সম্ভব হয়েছে। শহীদদের আত্মা আজ শান্তি পেয়েছে।
দল ও সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ঈর্ষণীয়ভাবে সফল। দলকে পাঁচবার ক্ষমতায় নেওয়া এবং দেশকে উন্নতির উচ্চ শিখরে নিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের ফল। তিনি যদি ১৯৮১ সালের ১৭ মে সাহস করে দেশে ফিরে না আসতেন এবং দলের হাল না ধরতেন তাহলে আজকের এই বাংলাদেশের চিত্র কি কল্পনা করা যায়? সামরিক শাসনের যাতাকলে পিষ্ট আর ধর্মীয় জঙ্গিবাদের লীলাভূমি আরেক পাকিস্তানের দশা হতো এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আজ যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন অগ্রগতি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে তার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৮১ সালের ১৭ মে। যে পরিবেশেই সেদিন শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফিরুক না কেন সেদিনের সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তরই ফল আজকের এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। সেদিন যে সকল মহৎপ্রাণ বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা ওই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন তাদের আজ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয়। সময়ের কারণে বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য যা করে যেতে পারেননি সেই কাজই শেখ হাসিনা সম্পন্ন করলেন। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নই শেখ হাসিনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। আর এটাই হচ্ছে সাহস করে সেদিন দেশে ফেরার সার্থকতা। শেখ হাসিনা মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় সুস্থভাবে শত বছর বেঁচে শেষ দিন পর্যন্ত দেশের নেতৃত্ব দিয়ে যাক সেই প্রত্যাশা দেশের মানুষের ।
লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সারাবাংলা/এজেডএস