কোরবানি কোনও অঘোষিত প্রতিযোগীতা নয়
১৭ জুন ২০২৪ ১৩:০৩
“বলুন! আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে, তার কোন শরীক নেই, আর আমি এর জন্যই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।” (সূরা আনআম: ১৬২-১৬৩) এ আয়াতের মর্মকথা হচ্ছে আমাদের জীবনের সকল ইবাদত ও কাজ কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে। আমাদের কাজের প্রকৃত লক্ষ্য থাকবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। ঈদ ও কোরবানি এ দু’টি কাজই মূলত আল্লাহর ইবাদত ও মুমিন বান্দাদের প্রতি মহান রাববুল আলামীনের বিশেষ অনুগ্রহ। কোরবানির মধ্যে ত্যাগ ও উৎসর্গের মর্মনিহিত থাকলেও ঈদ শব্দের মঝে মিশে আছে হাসি-খুশি, আনন্দ-ফুর্তি ও সম্মিলন এবং উৎসবের অর্থ। আনন্দ-ফুর্তি ভালবাসা আর পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির মাধ্যমেও যে আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হওয়া যায় ঈদ তার অনন্য দৃষ্টান্ত।
মুসলমান জাতির সাংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হলো ঈদ। ইসলামের এ সংস্কৃতি মূলত সার্বজনীন ও ব্যাপক। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের মাধ্যমে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। এতে আমরা ত্যাগ ও বিসর্জনের মহিমায় আমাদের জীবনকে আলোকিত করতে পারি। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আত্মত্যাগের যে উত্তম নমুনা ইবরাহিম (আ.) পেশ করেছেন কোরবানি ঈদ আজো তা প্রতিটি মুসলিমের অন্তরে জাগরিত করে তোলে। নিজের জীবনকে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করার মহান শিক্ষা অর্জন এবং ইবরাহিম (আ.) এর পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানির সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার বার্তা নিয়ে প্রতি বছর আগমন করে কোরবানির ঈদ। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ইবরাহিম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আল মুমতাহিনা-০৪) এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম যাদের ইবন আরকাম রাদি আল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদিসে ইরশাদ করেন: এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.) এর সুন্নত। (সুনান ইবন মাজহ-৩১২৭)
কোরবানির ঈদ
কোরবান শব্দটি কোরবুন শব্দ থেকে উৎকলিত। অর্থাৎ নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। যেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার মাধ্যম হল কোরবানি তাই এর নাম কোরবানির ঈদ। শরীয়তের পরিভাষায় ১০ই জিলহজ ফজর হতে ১৩ই জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্ধারিত পশু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জবেহ করাকে কোরবানি বলে। এই দিনে ঈদ পালন করা হয়ে থাকে এজন্য একে কোরবানির ঈদ বলে। এ ঈদের অপর নাম ঈদুল আজহা। আরবি শব্দ আজহা অর্থ কোরবানির পশু, যেহেতু এই দিনে কোরবানির পশু জবেহ করা হয়, তাই একে ঈদুল আজহা বলা হয়। কোরআন মাজিদে এসেছে ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি কর।’ [সূরা কাউসার-০৩]
কোরবানি কেন
কোরবানি একটি অন্যতম ইবাদত। ইসলামী বিধানে ইবাদত তিন রকম। একটি শারীরিক, অন্যটি আর্থিক আর তৃতীয়টি আর্থিক ও শারীরিক। সালাত ও সিয়াম যেমন শারীরিক ইবাদত তেমনি জাকাত ও কোরবানি হলো আর্থিক ইবাদত। তৃতীয় ইবাদত হলো আর্থিক ও শারিরিক যেমন হজ্জ। যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ আছে তারা শারীরিক ইবাদতের পাশাপাশি আর্থিক ইবাদতেও সমান যত্নবান হবেন এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। এই লক্ষ্যেই আল্লাহ কোরবানির বিধান নাজিল করেছেন।
কোরবানির জন্য নিয়ত
কোরবানির জন্য নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। নিয়ত সহিহ-শুদ্ধ না হলে কোরবানি হবে না। ইসলামের যে কোন ইবাদতই এই নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। কোরবানির সূচনাই হয়েছে নিয়তকে কেন্দ্র করে। নিয়ত সহিহ-শুদ্ধ হলে কোরবানি আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়, নিয়ত সহিহ না হলে আল্লাহ কারো কোরবানি কবুল করেন না। মানব সভ্যতার শুরুতে যখন কোরবানির বিধান চালু হয় তখন থেকেই এই এই ধারা চলে আসছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে কোরবানির সূচনা হয় হযরত আদম আলাইহিস সালামের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কোরবানির মাধ্যমে। তাদের একজনের কোরবানি আল্লাহ কবুল করেন, অন্য জনেরটা করেননি। এই না করার কারণ ছিল সহিহ নিয়তের অভাব। সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন : ‘আর তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের ঘটনা ঠিকমত শুনিয়ে দাও। যখন তারা দুই জনেই কোরবানি করলো, তখন তাদের একজনের কোরবানি কবুল হলো, আর অন্য জনের কোরবানি কবুল হলো না’। কোরবানির গোশত বা রক্ত কোন কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না, আল্লাহর দরবারে পৌঁছে বান্দার তাকওয়া। কোরবানিদাতাই সে গোশত ভোগ করে। গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়তে কোরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। আমাদের সমাজে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য কে কত দামী পশু কোরবানি করলো তার প্রতিযোগিতা অনেক সময় লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক সম্মান বজায় রাখার জন্য কোরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানির সহিহ-শুদ্ধ নিয়ত করা অত্যাবশ্যক। নিয়ত পরিশুদ্ধ হলে আল্লাহ বান্দার কোরবানি অবশ্যই কবুল করবেন।
কোরবানির ইতিহাস
কোরবানি আল্লাহ তাআলার একটি বিধান। আদম আলাইহিস সালাম হতে প্রত্যেক নবির যুগে কোরবানি করার ব্যবস্থা ছিল। যেহেতু প্রত্যেক নবির যুগে এর বিধান ছিল সেহেতু এর গুরুত্ব অত্যধিক। যেমন ইরশাদ হয়েছে: ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুস্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। [সূরা আল হাজ্জ-৩৪] ‘আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, তখন তারা উভয়ে কোরবানি পেশ করল। অতঃপর একজন থেকে গ্রহণ করা হলো আর অপরজনের থেকে গ্রহণ করা হলো না।’ [সূরা আল মায়িদাহ-৩৪]
আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বন্ধু ইবরাহিম আলাইহিস সলামকে বিভিন্ন পরীক্ষা অবতীর্ণ করেছেন এবং ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর স্মরণ কর, তখন ইবরাহিমকে তার রবের কয়েকটি বাণী দিয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর সে তা পূর্ণ করল। তিনি বললেন, আমি তোমাকে নেতা বানাবো’। [সূরা আল বাকারাহ-১২১৪] নিজ পুত্র জবেহ করার মত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। এ বিষয়ে সূরা আস-সাফ্ফাতের ১০০ থেকে ১০৯ আয়াতে বলা হয়েছে, তিনি বললেন, ‘হে প্রভু! আমাকে নেক সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম এক অতীব ধৈর্যশীল সন্তানের। পরে যখন সে সন্তান তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর বয়সে পৌঁছলো তখন তিনি (ইবরাহিম আ.) একদিন বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাকে জবেহ করছি এখন তুমি চিন্তা-ভাবনা করে দেখ এবং তোমার অভিমত কী? তিনি (ইসমাঈল) বললেন, হে পিতা আপনি তাই করুন যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অতঃপর যখন দু’জনই আল্লাহর আদেশ মানতে রাজি হলেন, তখন তিনি (ইবরাহিম আ.) পুত্রকে জবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন। আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইবরাহিম! তুমি আমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই নেক বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই ইহা বড় পরীক্ষা। আর আমি তাকে বিনিময় করে দিলাম এক বড় কোরবানির দ্বারা এবং তা পরবর্তীর জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহিম (আ.)এর উপর।’ একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় এবং আল্লাহ প্রদত্ত কঠিনমত পরীক্ষায় সাফল্যজনকভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার উদ্দেশ্যে এক মহান পিতার প্রাণাধিক পুত্রকে কোরবানি করার মধ্য দিয়ে ধৈর্যশীলতার উত্তম নমুনা পেশ পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। কোরআন মাজিদে উল্লেখিত আয়াতসমূহে ইবরাহিম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস সালামের আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতি সীমাহীন আনুগত্যের সাবলীল বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্বীয় পুত্র জবেহ না হয়ে দুম্বা জবেহ হওয়ার মাধ্যমে উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়। আল্লাহ তায়ালা ইরাশাদ করেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং পশু কোরবানি কর।’
কোরবানি কাদের ওপর ওয়াজিব
কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য প্রয়োজন নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা। জাকাতের মত নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ এক বছর ধরে কারো কাছে জমা থাকা এ ক্ষেত্রে জরুরী নয়। মাসয়ালা বা নিয়ম হচ্ছে, ১০ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত কারো কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি ওয়াাজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য আরও যে সব শর্ত প্রযোজ্য তা হল, যিনি কোরবানি দেবেন তাকে হতে হবে মুসলমান ও সুস্থ-মস্তিষ্কের মানুষ। তাকে হতে হবে বালেগ এবং পূর্ণ বয়স্ক। তাকে হতে হবে মুকিম, মানে মুসাফির নন এমন ব্যক্তি। মুসাফিরের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। কোন মহিলা নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি ব্যাপারে নারী ও পুরুষে কোন পার্থক্য নেই। সক্ষম সবার জন্যই কোরবানি ওয়াজিব।
কোরবানির উদ্দেশ্য
কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ রাববুল আলামিন মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধু তার ইবাদত করার জন্য। তাই আল্লাহ তায়ালার বিধান তার নির্দেশিত পথে পালন করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমি জিন ও মানুষকে এ জন্য সৃষ্টি করেছি যে, তারা শুধু আমার ইবাদত করবে।’ [সূরা আয্যারিয়াত-৫৬]। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কোরবানির বিধান আমাদের উপর আসার বেশ কিছু উদ্দেশ্যও রয়েছে।
১. শর্তহীন আনুগত্য: আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাহকে যে কোন আদেশ দেওয়ার ইখতিয়ার রাখেন এবং বান্দাহ তা পালন করতে বাধ্য। তাই তার আনুগত্য হবে শর্তহীন। আল্লাহর আদেশ সহজ হোক আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে একই মন-মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধকতা হতে পারে না। কোরআনুল কারীম আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহ রাববুল আলামীন ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে আনুগত্যের চরম পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছিলেন। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। তিনি বলতে পারতেন যে, হে আল্লাহ! তোমার জন্য আগুনে গিয়েছি, ঘরবাড়ি ছেড়েছি, আত্মীয়-স্বজন সব কিছু হারিয়েছি, এসব কিছুর বিনিময়ে আমার স্নেহের সন্তানটিকে কোরবানি করা থেকে রেহাই দাও। কিন্তু তা তিনি করেননি; বরং আল্লাহ হুকুম করেছেন তা শর্হহীনভাবে মেনে নিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর আনুগত্য পালনের ব্যাপারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
২. তাকওয়া অর্জন: তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানিদাতা আল্লাহ রাববুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন: ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে। (সূরা-আলহাজ্ব-৩৭)
৩. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা : প্রত্যেক ইবাদতই আল্লাহর শেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে। তাই কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা বলেন : আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, আল্লাহ তোমাদের সহজ চান, কঠিন চান না, আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করতে পারো এবং তিনি তোমাদেরকে যে, হিদায়াত দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশ কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর। (সূরা- আল বাকারাহ-১৮৫)
৪. ত্যাগ করার মহান পরীক্ষা : কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ত্যাগ করা মানসিকতা তৈরি করা। আল্লাহর বিধান পালনে জানমালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কোরবানির ঈদকে গোশত খাওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত করা নয়, বরং নিজেদের মধ্যকার পশুসুলভ আচরণ ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নফসের আনুগত্য ত্যাগ করে আল্লাহর একান্ত অনুগত হওয়াই কোরবানির উদ্দেশ্য। ‘আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়, দারিদ্র্য, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতি করার মাধ্যমে পরীক্ষা করবো।’ (সূরা- আল বাকারাহ-১৫৫)
কোরবানির ফজিলত
কোরবানির ফজিলতের উপর কয়েকটি কথা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল :
১. কোরবানিদাতা কোরবানির পশুর জবাই-এর মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.) ও শেষ নবি (সা.) এর সুন্নাতের বাস্তবায়ন করতে পারে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা: ‘আর আমরা মহা কোরবানির বিনিময়ে তাকে মুক্ত করেছি।’ (সূরা আস-সাফফাত-১০৭) এ আয়াতের তাফসীরে তাফসীর বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন, ‘সকল কোরবানি এ মহাকোরবানির অন্তর্ভুক্ত।’ এ জন্য রাসূল (সা.) যায়েদ ইবনে আরকাম বর্ণিত হাদিসেও কোরবানিকে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নত হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
২. কোরবানির রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল আলামীনের নৈকট্য অর্জিত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- ‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্ম পরায়ণদেরকে।’ (সূরা- আলহাজ্ব : ৩৭)
৩. কোরবানি আল্লাহতা’য়ালার অন্যতম নিদর্শন। সূরা হজ্বের ৩৬নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- অর্থাৎ কোরবানির উটসমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনের অন্যতম করেছি। তোমাদের জন্য যাতে কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দন্ডায়মান অবস্থা এগুলোর উপর তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ করো আর যখন কাত হয়ে পড়ে যায় তখন সেগুলো হতে খাও। আর আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবী ও ভিক্ষাকারী অভাবগ্রস্তকে এভাবে আমি ওদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। এ আয়াতে কোরবানির ফযিলত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং কোরবানির পশুকে আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
৪. পশু দ্বারা কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর জিকির বা স্মরণের বাস্তবায়ন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে: অর্থাৎ আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানির নিয়ম করে দিয়েছে। তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরপ যে সকল চতুস্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম স্মরণ করে। [সূরা : আলহাজ্জ-৩৪] প্রকৃতপক্ষে পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর স্মরণকে বাস্তবায়নের এ সুমহান নিদর্শন বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
৫. কোরবানির প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তায়ালার কাছে দুটি কুচকুচে কালো ছাগলের চেয়ে প্রিয় ও পবিত্র। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে আবু হুরায়রা রাদি আল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: অর্থাৎ কোরবানির প্রবাহিত রক্ত আল্লাহ তায়ালার কাছে দুটি কুচকুচে কালো ছাগলের চেয়ে অধিক প্রিয়। [সুনান বায়হাকী]
বাড়াবাড়ি বা প্রতিযোগিতা কাম্য নয়
কোরবানি একটি ইবাদত। মহান প্রভুর সান্নিধ্য অর্জন করার অন্যতম একটি মাধ্যম। ত্যাগ-বিসর্জনের উদারহন। কোরবানির ইতিহাস আমদেরকে সেই শিক্ষাই প্রদান করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে কালের স্রোত আর আত্মঅহমিকার ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ত্যাগের শিক্ষা। কোরবানি হয়ে উঠেছে সামাজিক স্ট্যাটাস রক্ষা এবং বড়ত্ব প্রকাশ করার মাধ্যম। কুরবানীর সময় সমাগত হলেই মানুষের মধ্যে গরুছাগল কেনার ধুম পড়ে। এক প্রকার অঘোষিত প্রতিযোগীতা চলে, কে কয়টা গরু কোরবানি দেবে, কত বেশী দামের কোরবানি দেবে। ভাবখানা এমন হয়ে দাঁড়ায়, বড় গরু আর বেশি গরু কোরবানি দেওয়াটাই বেশি সামাজিক, বড় মানবকল্যানী হওয়ার প্রমাণ-পরিচয়। মাঝে মধ্যে এটা পত্রিকায়ও কিছু কিছু খবর প্রকাশ করা হয়। লেখা হয়- অমুকে অত লক্ষ টাকা দিয়ে একটা কোরবানির গরু কিনেছে। অমুক হাটের সবচেয়ে বড় গরুটি কোরবানির জন্য ক্রয় করেছেন তমুক ভাই। সাম্প্রতিক বছর সমূহে অবশ্য কোরবানীতে আরও একটি নতুন সংযোজন ঘটেছে। অথবা বলা যায় বৈচিত্র এসেছে। তা হলো উট কোরবানী করা। উট হলো মরুর দেশের প্রাণী। তথা আরব দেশের জন্তু। ইসলামের জন্মও আরব দেশে। তাই মানুষের মনে এ ধারনা পোষণ করতে পারে যে, উট কোরবানীতে মনে হয় বেশী সওয়াব। বেশী নাকি কম সওয়াব তা সঠিক জানা না গেলেও উট কোরবানি দিলে এলাকায়, এলাকার আশে পাশের এলাকায় প্রচার ভাল পাওয়া যায়। একটি কথা আমাদের সবার মনে রাখা দরকার, পবিত্র কোরআনে স্পস্টভাবে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘কোরবানির গরুর রক্ত, মাংস এবং হাড় এর কিছুর আমার কাছে পৌছায় না। আমার কাছে পৌছায় কোরবানিদাতার তাকওয়া, বান্দার মনের পবিত্র ইচ্ছা।’
লেখক : চেয়ারম্যান, ইসলাম প্রতিদিন
সারাবাংলা/এসবিডিই