পদত্যাগ কিংবা ক্ষমতার রং বদল
১৫ আগস্ট ২০২৪ ১৮:৪১
বর্তমানে দেশে পদত্যাগের ঢেউ উঠেছে। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ চাপে পড়ে পদত্যাগ করছে। বাংলাদেশের জনগণ এ ঘটনায় অবাক, যেন এমন কিছু আগে কখনো ঘটেনি। তবে, এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়। বরং দেশের ইতিহাসে প্রতিটি সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ধরনের পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। আমাদের দেশের মানুষ যেন এই সত্যটি ভুলে গেছে, হয়তো তাদের স্মৃতি গোল্ডফিশের মতো ক্ষণস্থায়ী, অথবা তারা স্থায়ীভাবে ডিমেনশিয়ার শিকার।
সরকার বদলের সঙ্গে পদত্যাগের সম্পর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকার তার মনের মতো মানুষদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছে। নতুন ক্ষমতাসীনরা স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যক্তিদের অপসারণ করতে চাইবে এবং তাদের নিজস্ব অনুগত ব্যক্তিদের এসব পদে বসাতে চাইবে। এটি রাজনৈতিক বাস্তবতা।
এরশাদ পতনের পর আমরা গণপদত্যাগ দেখেছি। খালেদা জিয়ার আমলেও তার অনুসারীদের পদত্যাগ করতে দেখেছি। হাসিনার অনুগত যারা ছিলেন, তারা এখন বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তবে, পদত্যাগ সব ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না; বরং জেল বা জরিমানার মতো শাস্তি হতে পারে। মন্ত্রীরা ইতোমধ্যেই মাঝির বেশে পালানোর চেষ্টা করছেন। কেউ হয়তো বোরকা পরে, কেউ তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে পালানোর চেষ্টা করবে। এসব নাটকীয়তায় আমরা অভ্যস্ত; এখানে নতুন কিছুই মঞ্চস্থ হচ্ছে না।
ক্ষমতার পালাবদলে যারা বর্তমানে ক্ষমতায় আছে, তারা সুযোগ পেয়ে যথেষ্ট অর্থ কামাই করবে। সরকার পতনের পর অনেক ঘটনা পর্দার আড়ালে ঘটে যাবে। দেখা যাবে, সরকারের অনেক মন্ত্রী তথাকথিত ‘মহামানবদের’ আশ্রয়ে নিরাপদ জীবন যাপন করছে। আবার কেউ কেউ এই সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত জেল থেকে বের হওয়ার চিন্তা করতে পারবে না। হাসিনার নামে মামলা হয়েছে মাত্র একটি, তবে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় যে কমপক্ষে ২০০ মামলা তার বিরুদ্ধে করা হবে। বর্তমান সরকার যে উপদেষ্টাদের নিয়ে চলছে, তারা ভালো করেই জানেন হাসিনা কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তাকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না। যে কোনো মামলায় তাকে কমপক্ষে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হবে, যাতে বিদেশে থাকলেও তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন।
সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রীরাই হয়তো নির্বাচনের সুযোগ পাবে না। যখন ক্ষমতা হারায়, তখন তাদের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত হয় না। এখন আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারিত হবে না, বরং বিএনপি বা জামায়াতের মতো প্রতিপক্ষদের নাম উচ্চারিত হবে। ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মিডিয়াতে, যারা আওয়ামী লীগের বন্দনায় নিজেদের ধন্য মনে করত, তারা এখন আওয়ামী লীগকে অবহেলিত এবং নিচু জাতির মতো দেখতে শুরু করবে। তাদের নাম উচ্চারণের পূর্বে তাচ্ছিল্য ও স্ল্যাংয়ের ব্যবহার প্রবল হবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিরোধী দলের প্রতি যে আচরণ করেছিল, সেটিই এখন তাদের সাথে হবে। যারা মনে করছেন বর্তমান সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হবে না, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। বাংলাদেশ মূর্খদের দেশ, যেখানে অল্প সংখ্যক মানুষই শুদ্ধ চিন্তা করতে পারে, আর অধিকাংশই প্রতিহিংসাপরায়ণ ও শয়তানের পূজারী।
এই সরকারের প্রথম পদক্ষেপগুলির মধ্যে রয়েছে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বাতিল করা। জাতীয় শোক দিবস কোনো রাজনৈতিক ঘটনা নয়, এটি আমাদের জাতীয় জীবনের প্রথম কলঙ্ককে স্মরণ করার দিন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডের দিন। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ করেছিল, তবে বর্তমান সরকার যদি উদারমনা হতো, তবে বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত না করে পুরো বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত করত। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন না করলে, আজকের অনেকেই মহামানব সাজতে পারত না। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো মানে বাংলাদেশকে সম্মান জানানো। বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার অর্থ বাংলাদেশ বা নিজেকে অপমান করা।
আওয়ামী লীগ নিজের পাপে পাঁকে পড়েছে। এখন যত ব্যাঙ, মাছি এবং চামচিকা আছে, তারা তাদের পঙ্গু পায়ে এসেও লাথি মারবে। এই লাথি আওয়ামী লীগকে সহ্য করতে হবে।
সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পূর্বের সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই সরে যাবে। স্বেচ্ছায় গেলে হয়তো কিছুটা সম্মান রক্ষা হবে, কিন্তু ঘাড় ধরে যদি বের করে দিতে হয়, সেটা এত দিনের পাপের ফল হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।
বর্তমান সরকারও ইতোমধ্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। পদত্যাগের সময়টুকুও দিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সরকারের কিছুটা হলেও চক্ষুলজ্জা ছিল, তারা তড়িঘড়ি কোনো কিছু করেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে বন্দুক তাক করেছে। সিলেটের মুসলিম সাহিত্য সংসদ বর্তমান সরকারের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। পড়লেও সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় এটি ক্ষুদ্র। সরকার এখানে নাক না গলালেও পারত। তথাকথিত মহামানবদের সিলেট শাখা এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদককে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিয়েছে। ভদ্রলোক নিরীহ, গবেষণা ও লেখালেখি তার জীবনের ব্রত। পদ-পদবীর লোভ তার ছিল না। প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করে তিনি সসম্মানে পদত্যাগ করেছেন। শুনেছি, মহামানবদের সিলেট শাখার জামাত উপশাখার একজন এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দেশে গেলে হয়তো দু-এক মিনিটের জন্য এই প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু চন্দ্র ভ্রমণের অনুসারী কেউ যদি দায়িত্ব নেয়, তাহলে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে, আর অন্ধকার আমি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি।
একটি বিষয় পরিষ্কার করি, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে আমরা ছিলাম এবং আছি। কিন্তু এখন দেখছি, এই আন্দোলনের ৯০% নেতৃত্ব চলে গেছে জামাতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের হাতে। হয়তো অনেকে আমার কথা উড়িয়ে দেবেন, তবে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একবার চোখ খুলে দেখুন, কারা এই বৈষম্যের নেতৃত্ব দিচ্ছে। জামাত-শিবির যদি সত্যিই সুযোগ পায়, তাহলে তথাকথিত মহামানবদের সবাইকে চন্দ্র ভ্রমণে পাঠিয়ে দেবে। তাই সাধু সাবধান!
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই