শিল্পের শুদ্ধতা বনাম ব্যক্তিগত পছন্দ
৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:০৫
বাংলাদেশে সামাজিকভাবে আমরা প্রায়ই একটা বিষয় খুব তীব্রভাবে অনুভব করি—একটা শ্রেণি নিজেকে ‘উচ্চতর’ এবং বাকিদেরকে ‘নিম্ন’ মনে করে। বিশেষ করে, শিল্প, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতি নিয়ে এদের অবস্থান যেন খুব দৃঢ়। এই শ্রেণির কাছে ‘উচ্চমানের’ শিল্প কি, ‘রুচিশীল’ গান কি, সেই সবের একটি পূর্বনির্ধারিত মানদণ্ড রয়েছে। এবং সেটাই তারা আমাদের সবার ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। এটা শুধু রুচির বিষয় নয়, বরং মানসিকতার একটি ফ্যাসিস্টিক প্রতিফলন।
মমতাজ বা হিরো আলমের নাম শুনলেই কিছু মানুষের নাক সিটকানোর দৃশ্য খুবই পরিচিত। তাদের কাছে মমতাজ বা হিরো আলমের গান শুনলে যেন একধরনের ‘রুচির অবক্ষয়’ ঘটছে। অথচ, এই গানগুলো সাধারণ মানুষের মনের কথা বলে, তাদের জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরে। আর এই বাস্তবতা যে তথাকথিত শিক্ষিত, সুশীল সমাজের কাছে রুচির বিকৃতি বলে মনে হয়, সেটাই প্রমাণ করে আমাদের সমাজে রুচি নিয়ে একটি গভীর বিভাজন আছে।
মমতাজের মতো শিল্পীরা মূলত আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ধারক। তার গানগুলো সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে। ‘বুকটা ফাইট্টা যায়’ গানটি যেমন একজন টেম্পু ড্রাইভার, রিকশাওয়ালা, বা ময়লা পরিষ্কারের শ্রমিকের জীবনের বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলে। তাদের জীবন হয়তো তথাকথিত সুশীল সমাজের উচ্চস্তরের জীবনের মতো সুন্দর নয়, কিন্তু সেই জীবনের অনুভূতিগুলোও ততটাই সত্যি। মমতাজের মতো শিল্পীরা সেই সত্যগুলো তাদের গানের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন। তাদের এই প্রকাশভঙ্গি অনেকের কাছে ‘স্থূল’ মনে হতে পারে, কিন্তু এটাকে কখনোই হেয় করা উচিত নয়।
এখানেই এসে দাঁড়ায় রুচির প্রশ্ন। আমরা ‘রুচি’ বলতে আসলে কি বুঝি? যেটা কিছু মানুষের কাছে নান্দনিক ও শালীন মনে হয়, সেটাই কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে? যদি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোনো গানকে তার নিজের অবস্থানের সাথে মেলাতে না পারেন, সেটার মানে কি সেই গান খারাপ? আমরা জানি যে নান্দনিকতার সংজ্ঞা সময়, সমাজ এবং ব্যক্তির অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। একজন অধ্যাপক যে গানকে রুচিহীন ভাবেন, সেটাই হয়তো অন্যের কাছে শিল্পের এক বিশেষ রূপ হতে পারে। এই দ্বৈত মানসিকতাই সমাজে শ্রেণি বিভাজন তৈরি করে।
এই দ্বৈত চিন্তাধারার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে হিরো আলম। তার গান, পারফরম্যান্স, এবং ইউটিউবের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, মানুষের কাছে বিনোদন এবং শিল্পের সংজ্ঞা ভিন্ন হতে পারে। ইউটিউবের প্রসার, সোশ্যাল মিডিয়া এবং গ্লোবালাইজেশনের মাধ্যমে নতুন ধরনের বিনোদন আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে। হিরো আলম হয়তো সুর, তাল, লয় সম্পর্কে খুব একটা জানেন না, কিন্তু তার উপস্থিতি এবং সাধারণ মানুষের সাথে তার সংযোগ তাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে, যেটা তথাকথিত সুশীল সমাজ সহজে মেনে নিতে পারছে না।
একটা জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে গুগলে সবচেয়ে বেশি খোঁজা হয় হিরো আলমকে। এর অর্থ হলো, সাধারণ মানুষ তার বিনোদনমূলক কন্টেন্টকে গ্রহণ করছে। এটাই হলো বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রুচি। অথচ, আমাদের সুশীল সমাজ তাকে নিয়ে নাক সিটকায়। তারা ভাবে, যেটা তাদের রুচির মাপকাঠিতে ঠিক নয়, সেটা মানেই নিম্নমানের। অথচ, এই মনোভাবই প্রকৃতপক্ষে তাদের সংকীর্ণতা এবং ফ্যাসিস্টিক চিন্তাধারার পরিচায়ক।
কেউ যদি রুচির অবক্ষয় নিয়ে সোচ্চার হন, তাহলে সমৃদ্ধির রুচি বলতে কি বোঝায় সেটা স্পষ্ট করতে হবে। কারণ, আমরা যদি রুচির মানদণ্ডগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে যে, রুচি একেবারে ব্যক্তিগত একটা বিষয়। আমরা কিভাবে পোশাক পরি, কি ধরনের গান শুনি, আমাদের সাহিত্যিক রুচি কেমন—এসবের উপর নির্ভর করে আমাদের রুচি। কিন্তু সেটা সবসময় সমাজের বাকিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, এমনটা আশা করা যায় না।
রুচির এই বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করাটাই হচ্ছে প্রকৃত মানবিকতা। একজন প্রকৃত শিল্পমনস্ক ব্যক্তি কখনোই অন্যের রুচিকে হেয় করবে না। বরং তিনি বুঝতে পারবেন, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ তার নিজস্ব জীবন অভিজ্ঞতা থেকে তার রুচি গড়ে তোলে। আমরা যদি অন্যের রুচির প্রতি সম্মান না দেখাই, তাহলে সেই মানসিকতা ফ্যাসিবাদী চিন্তাধারায় রূপান্তরিত হয়।
মমতাজের গানকে যারা ‘স্থূল’ বলে অভিহিত করেন, তারা বুঝতে চান না যে, এই গানগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাজের অনেকের কষ্টের কাহিনি। তাদের কাছে এই গানগুলো শুধু বিনোদন নয়, বরং তাদের জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা বলার একটা মাধ্যম। সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য মমতাজের গানগুলো একটা মুক্তির উপায়, একটা সংযোগের সূত্র। যেটা তারা নিজেদের জীবনের সাথে মিলাতে পারে। আর সেটা বোঝার মতো হৃদয়, সম্ভবত তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সুশীল সমাজের নেই।
‘খাইরুন লো’ গানের কথাগুলো হয়তো প্রথাগতভাবে ‘অভিজাত’ বা ‘উচ্চমানের’ বলে গণ্য হবে না, কিন্তু তাতে শিল্প উপাদানের অভাব নেই। এই গানগুলো আমাদের লোকজ সংস্কৃতির প্রতিফলন। আর এটাই তো আমাদের শেকড়ের সাথে সংযুক্ত থাকার বড় একটা প্রমাণ। কিন্তু যারা নিজেদের ‘উচ্চমানের রুচির’ দাবি করেন, তারা এসবকে অবজ্ঞা করেন। কারণ, তাদের কাছে শিল্পের সংজ্ঞা একরকম। অন্য যেকোনো ধরনের শিল্পকেই তারা নিচু চোখে দেখেন।
এই চিন্তাধারাটা, যেখানে নিজের রুচিকে একমাত্র গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়, তা প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদী মানসিকতারই প্রতিফলন। এই মানসিকতা হলো—যদি আমার রুচি ‘সঠিক’ হয়, তাহলে অন্যের রুচি ভুল। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই মনোভাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। শিল্প কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটা সার্বজনীন, এবং তার মধ্যেই রয়েছে অসংখ্য বৈচিত্র্য।
আমাদের সমাজে যারা নিজেদের ‘সুশীল’ বলে দাবি করেন, তাদের বোঝা উচিত যে, রুচির মাপকাঠি কখনোই এক নয়। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে রুচিতে বিশ্বাস করে, সেটাও সমানভাবে সম্মানের দাবিদার। একজন প্রকৃত মানবিক মানুষ কখনোই অন্যের রুচিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে না। বরং, তিনি সবার পছন্দ এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে মর্যাদা দেবেন। কারণ, শেষ পর্যন্ত, মানবিকতা হলো একে অপরের প্রতি সম্মান দেখানো।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই