Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উত্তর জনপদের স্বপ্নের প্রতীক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী
১২ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:২৬

২০০৮ সালে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে যে প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি আজ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) নামে উত্তর জনপদের মানুষের স্বপ্নের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। ‘রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় চাই’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে সেই সময় সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যাক্তিত্ব অধ্যাপক ড রেজাউল হক স্যারের নেতৃত্বে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সমন্বয় পরিষদ গঠিত হইয়েছিল। এ আন্দোলনের সফলতার মধ্য দিয়ে রংপুরের গর্বিত সন্তান অধ্যাপক ড. মো. লুৎফর রহমান স্যারকে প্রথম উপাচার্য করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় তার যাত্রা শুরু করে।

বিজ্ঞাপন

এই বিশ্ববিদ্যালয়, ২০২৪ সাল পর্যন্ত, পাঁচজন উপাচার্যের নেতৃত্ব পেয়েছে। এরপর, ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে আমি গত ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ তারিখে দায়িত্বভার গ্রহণ করি। দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়টি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। জুলাই বিপ্লবের পর প্রায় দুই মাস উপাচার্যশূন্য থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। তবে আমি যোগদানের পরপরই জরুরী সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পুনরায় স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিই। ২৫ সেপ্টেম্বর হল খুলে দেই। ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু করি।

বিজ্ঞাপন

সেইসঙ্গে, জুলাই বিপ্লবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে সিন্ডিকেটের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। যতদূর সম্ভব, আমি সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কাতারে নিজেকে শামিল করার আন্তরিক চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ এবং কর্মকাণ্ডকে সুষ্ঠু ও গতিশীল রাখার জন্য তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় কেবলমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি পরিবারের মতো, যেখানে প্রতিটি সদস্যের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এর অগ্রগতি নির্ভর করে। আমি বিশ্বাস করি, প্রশাসনের দায়িত্ব কেবল নির্দেশনা প্রদান করা নয়, বরং সবার পাশে থেকে তাদের প্রয়োজনের মুহূর্তে সহযোগিতা করা এবং তাদের কণ্ঠকে শোনা। এই লক্ষ্যে, আমি নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করেছি, তাদের উদ্বেগ ও সমস্যা শুনেছি এবং সমাধানের জন্য যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিয়েছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এর প্রধান অংশীজন, তাই আমি সর্বদা তাদের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলি সরাসরি তাদের মুখ থেকে শোনা এবং তাদের চাহিদা ও প্রত্যাশা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেওয়ার জন্য আমি যথাসাধ্য সময় ব্যয় করেছি। অডিটোরিয়াম না থাকায়, আমি অনুষদভিত্তিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা আয়োজন করেছি, যেখানে তারা তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অডিটোরিয়ামের গুরুত্ব উপলব্ধি করে, আমি এই প্রতিষ্ঠানে একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমি ইতোমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।

শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা সমাধানে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো সশরীরে পরিদর্শন করেছি। প্রায় ৮০০০ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৮০০টি আবাসিক আসন থাকা এক বিশাল ঘাটতি, যা বিশ্ববিদ্যালয়টির সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বড় প্রতিবন্ধক। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি পূর্ণাঙ্গ আবাসিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আবাসিক আসনের সংখ্যা কমপক্ষে দশগুণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমি আমার দায়িত্বকালে দুইটি ছাত্র হল এবং দুইটি ছাত্রী হল নির্মাণের লক্ষ্য স্থির করেছি, যা শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করবে।

এছাড়াও, বিভিন্ন বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ নিয়ে যে জটিলতা ছিল, আমি তা আলোচনা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছি। সকল শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত মতবিনিময় করে তাঁদের যৌক্তিক সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করেছি এবং তাঁদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অধিকাংশ সমস্যার সমাধান আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সম্ভব। সেই লক্ষ্যে, আমি দল-মত নির্বিশেষে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় করেছি এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি। আমি কখনো কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর উপাচার্য হওয়ার চেষ্টা করিনি; বরং আমি নিজেকে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের একজন অভিভাবক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সবার সহযোগিতা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সহজেই সামনে এগিয়ে নিতে পারব, এবং এটি উত্তরবঙ্গের শিক্ষার এক উজ্জ্বল বাতিঘর হিসেবে গড়ে উঠবে।

আজকের দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের অগ্রদূত, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাইদসহ শত শত বীর শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা। তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে আরও স্মরণ করি সেই পঙ্গুত্ব বরণকারী ও আহত ছাত্র-জনতাকে, যাদের আত্মত্যাগে বাংলাদেশ নতুন পথে এগিয়ে চলেছে। শহীদ আবু সাইদের স্মৃতিবিজড়িত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আজ তার শহীদের নামে একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষভাবে ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি আবু সাইদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। গত ৯ অক্টোবর তাঁর ছোট বোনকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তবে এও স্পষ্ট যে, আবু সাইদের আত্মত্যাগের ঋণ কোনোদিনই আমরা শোধ করতে পারবো না। আবু সাইদের স্মৃতি বিজড়িত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ দিন থেকে বাজেট বঞ্চনার স্বীকার। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবতকালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রকল্প বরাদ্দ পেয়েছে ২০০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, অথচ বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেগুলো বেরোবির সমসাময়িক যারা এক অর্থ বছরে বরাদ্দ পায় এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই বাজেট বৈষম্য বেরোবিকে একটি উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠান(Center of Excellence) হিসেবে গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

আমি শুরু থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টাসহ অন্যান্য উপদেষ্টাদের পূর্ণ সহযোগিতা পেয়ে আসছি । বিশেষ করে, আবু সাঈদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানে যে উন্নয়ন বৈষম্য রয়ে গেছে, তা দূরীকরণের জন্য তাদের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি। জেনারেশন জেডের প্রতিনিধি এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে আমি আবু সাঈদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যয় নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছি। এজন্য রংপুরের সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মিলিত সহযোগিতা কামনা করছি, যাতে আমরা একযোগে এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের পথ সুগম করতে পারি।

লেখক: উপাচার্য, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী উত্তর জনপদের স্বপ্নের প্রতীক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর