আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে
২৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৪:৩৮
চারণ কবি মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪) এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে একটি যুগকে প্রভাবিত করেছেন। কমিউনিস্ট ছিলেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, মুকুন্দ দাসের মূল পরিচয় ছিল একজন মানুষ হিসেবে যিনি স্বাধীনতা, মানবমুক্তি এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণার উৎস। তার সৃষ্টিকর্মে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাব না থাকলেও, তার গানে যে সংগ্রামী চেতনা ছিল, তা বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছে। ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা উদীচীর মতো সংগঠনগুলো তার গানে মানুষের চেতনাকে জাগানোর চেষ্টা করেছে, কারণ তার সৃষ্টিকর্ম মানুষের হৃদয়ে দেশপ্রেম এবং সংগ্রামের আগুন জ্বালাতে সক্ষম ছিল।
মুকুন্দ দাসের জন্মের আগে ছাত্র ইউনিয়ন বা উদীচীর মতো রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্ম হয়নি। তবুও, তার গান এবং নাটকগুলো মানুষকে একত্রিত করেছিল। যখন স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন মুকুন্দ দাস তার গানে, যাত্রায় এবং নাটকে দেশপ্রেমের বাণী ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। তিনি বাউলদের মতো ঘুরে ঘুরে মানুষের মাঝে তার গানের মাধ্যমে স্বাধীনতার কল্পনা ছড়িয়ে দিয়েছেন।
মুকুন্দ দাসের গান মানুষকে এমনভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল যে, তা শুনে মানুষ নিজেদেরকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছিল। তার গান ছিল যেন একটি আগুনের গোলা, যা মানুষের হৃদয়ে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করত। তার গান যখন গ্রাম-শহরের পথে বাজতে শুরু করত, তখন মানুষ শুধু বিনোদিত হতো না, বরং নিজেদের মধ্যে নতুন উদ্যম খুঁজে পেত। তার গান ছিল স্রেফ গান নয়, তা ছিল স্বাধীনতার এক দৃঢ় আহ্বান।
মুকুন্দ দাসের অন্যতম প্রভাবশালী গান ‘ভয় কি মরণে’ সেই সময়ের স্বদেশী আন্দোলনে অপরিসীম প্রভাব ফেলেছিল। গানের বাণীগুলো ছিল এমনভাবে রচিত যে, তা শুনে মানুষের রক্ত গরম হয়ে যেত। গানটির বাণীগুলো ছিল—
“ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।।”
গানটির মূল সুর ছিল সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান। মাতঙ্গী দেবীর উন্মাদ রূপ, যা দানবদের বিনাশ করার জন্য প্রস্তুত, সেটিই যেন মুকুন্দ দাসের গানে স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। মাতঙ্গীর সেই শক্তিশালী প্রতীক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মানুষের নিজের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে ভয় পাওয়া উচিত নয়।
মুকুন্দ দাসের গান কেবলমাত্র বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের প্রতীক নয়, এটি ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রখর প্রতিবাদ। তার গানে ফুটে ওঠা শক্তিশালী প্রতীকগুলো মানুষকে সাহস যোগাতো, সেই সাহস যা মৃত্যুকেও তুচ্ছ করে স্বাধীনতার জন্য লড়তে প্রস্তুত করত। বিশেষ করে, তার বিখ্যাত গান “ভয় কি মরণে” ছিল সংগ্রামের মন্ত্রের মতো। এই গানের বাণী এমনভাবে মানুষের রক্ত গরম করত যে, তারা নিজেদেরকে দেশের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হতো।
ভয় কি মরণে গানটি একদিকে যেমন দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে জাতিগত ঐক্যের ডাক দিচ্ছে—হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে।
ভয় কি মরণে
রাখিতে সন্তানে,
মাতঙ্গী মেতেছে আজ
সমর রঙ্গে।।
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।
এই গানে ‘মাতঙ্গী’ প্রতীকী রূপে ব্যবহৃত হয়েছে, যা শক্তিশালী মাতৃমূর্তিকে চিত্রিত করছে। মায়ের মতো আত্মত্যাগী হতে হবে, এমন শক্তি বাংলার মাটিকে মুক্ত করতে পারবে। “দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী” পঙক্তিটি সেই সাহসী নারীর প্রতীক, যিনি বাংলার ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়কে বিনাশ করতে প্রস্তুত। মুকুন্দ দাসের এই গান তখনকার সময়ে যেমন দানবীয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ছিল, তেমনি আজকের সমাজের অসঙ্গতি এবং অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণাও হতে পারে।
সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান,
নিতে হয় মুকুন্দে-রে নিও রে সঙ্গে।।
এই গান শুধু শব্দের গাঁথুনি ছিল না, এটি ছিল একটি বিপ্লবের মন্ত্র, যা সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে উৎসাহিত করত। মুকুন্দ দাসের কল্পিত সেই দানব আজকের সমাজেও বিদ্যমান। আর তাই তার এই গানের চেতনা আজও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক— “আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে?”
মুকুন্দ দাসের গান এবং তার আদর্শগত চেতনা শুধু তৎকালীন সময়কেই প্রভাবিত করেনি, বর্তমানেও তার সেই সংগ্রামী সুর আমাদের অনুপ্রাণিত করে। উদীচী এবং ছাত্র ইউনিয়নের মতো সংগঠনগুলো মুকুন্দ দাসের গানকে তাদের কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছে, কারণ তার গানের শক্তি ছিল মানুষকে উদ্দীপ্ত করার। কিন্তু, মুকুন্দ দাস এবং তার গান যে সৎ উদ্দেশ্যে সমাজকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিল, অনেক সময় দেখা গেছে যে, সেই সংগঠনগুলো তাদের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।
অধিকাংশ সময়ে, দেখা গেছে তারা কোনো সঠিক আদর্শের প্রতি অনুগত থাকতে পারেনি এবং তাদের অনেক কর্মকাণ্ডই সময়ের সাথে স্বৈরাচারের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছিল। অথচ মুকুন্দ দাস ছিলেন সেই মানুষ, যিনি শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করে ছেন। তিনি নিজের আদর্শের প্রতি সর্বদা অটল ছিলেন, তার গান এবং নাটক মানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার পবিত্র বাণী পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
মুকুন্দ দাসের গান যখন একবার শুনতাম, তখন মনে হতো যেন নিজের শরীরে নতুন শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। “ভয় কি মরণে” গানের বাণী এমনভাবে গাঁথা ছিল যে, তা শুনলে মানুষের হৃদয় কঠিন হয়ে যেত এবং তারা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে প্রস্তুত হতো। এই গানটির মধ্যে যে সংগ্রামী চেতনা লুকিয়ে ছিল, তা শুধু স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নয়, আজকের সমাজেও প্রাসঙ্গিক।
গানের বাণী পড়লে সহজেই বোঝা যায় যে, এখানে একটি শক্তিশালী মাতৃত্বের প্রতীক, মাতঙ্গী দেবী, যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি সেই যুগের সমাজকে উদ্দেশ্য করে রচিত, যারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে নিপীড়িত ছিল। সেই সমাজের জন্য এই গান ছিল একটি প্রেরণার উৎস, যা তাদেরকে আত্মবিশ্বাস যোগাত যে, তারা যদি নিজেদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করে, তবে কোনো শক্তিই তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
মুকুন্দ দাসের প্রভাব আমাদের বর্তমানেও প্রতিফলিত হয়। তার গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে। যদিও সময়ের সাথে সাথে তার গান হয়তো অনেকের কাছে বিস্মৃত হয়েছে, তবুও তার সৃষ্টিকর্মের মহিমা কমে যায়নি। আজকের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে, মুকুন্দ দাসের গান আমাদের সেই সময়ের মতোই অনুপ্রাণিত করতে পারে। আজকের সময়েও মানুষ তার গান থেকে সংগ্রামের শক্তি খুঁজে পেতে পারে।
মুকুন্দ দাসের গানের মূল প্রেরণা ছিল মানবতার মুক্তি এবং সাম্যের লড়াই। সে কারণে, তার গানগুলো কেবলমাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ই নয়, বরং যে কোনো সময়েই মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম।
চারণ কবি মুকুন্দ দাসের সৃষ্টিকর্ম আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, স্বাধীনতা, সাম্য এবং মানবতার জন্য লড়াই কেবল একটি সময়ের জন্য নয়, বরং প্রতিনিয়ত চলমান একটি সংগ্রাম। তার গানগুলো আজও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক, কারণ এগুলো কেবল দেশপ্রেমের জন্য নয়, বরং মানুষের জন্য মানুষের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই