সংলাপ-সংস্কারে টানাপোড়েন: ১/১১ থেকে ২৪
২৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:২৪ | আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ১৪:৪০
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে মানুষের মুক্তির আকাঙক্ষাকে সামনে রেখে দেশে চলছে সংস্কার কর্মযজ্ঞ। চলছে বৈঠক, আলোচনা আর নাগরিক সমাজে কথোপকথনও। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আকাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রে উত্তরণের যে যজ্ঞ চলমান, তা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ এই সংস্কার-সংলাপ কতখানি সফলতার দিকে যাবে। সাফল্যের এই হিসাব আমাদের ইতিহাসের দিকে টেনে নেয়। রাজনীতির ইতিহাসে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের আগে ১/১১-এর সময়ও সংস্কার-সংলাপের মুখোমুখি হয়েছিলো দেশ।
ড. ইউনুসের নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশন ও এলডিপির সঙ্গে বৈঠক
এ বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ঐকমত্য কমিশন’। ইতোমধ্যে কমিশনটি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে।
১৫ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা এবং কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম বৈঠক। এতে অংশ নেয় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচনের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন দল ও জোট।
পরবর্তী পর্যায়ে ১৮ মার্চ জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠক হয় এলডিপি’র সঙ্গে। এলডিপি চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ২০০১-০৬ বিএনপি সরকারের সময় সংসদ সদস্য এবং দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন, ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং পরে দল গঠন করেন। ২০০৭ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের মহাজোটে অংশ নেন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ২০১৭ সালের ১০ মে ‘২০-৩০ ভিশন’ রূপকল্প তুলে ধরেন দলীয় চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ৩১ দফার রাষ্ট্র সংস্কার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। বর্তমানে ‘৩১ দফা’র ওপর ভিত্তি করে সারাদেশে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাশাপাশি যুগপৎ ধারায় আন্দোলনরত রাজনৈতিক শক্তিগুলোও স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ৩১ দফাভিত্তিক সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করে।
বিএনপি বর্তমানে রাজনৈতিক সংস্কারের অন্যতম নৈতিক ধারক ও বাহক হিসেবে সক্রিয়। যদি ঐকমত্য কমিশন বিএনপির ঐতিহাসিক ‘৩১-দফা’ ভিত্তি করে এগোয়, তাহলে দেশ ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিতভাবে সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কমিশনের নিজস্ব লক্ষ্য থাকলে, সময়ই বলে দেবে তারা সংস্কার কোন পদ্ধতিতে শেষ করবেন।
কিন্তু সংস্কারের শেষ হচ্ছে কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইতিহাসের দিকে মুখ ফেরালে আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে পারে।
ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিকল্প ধারায় শুরু হয়েছিলো ১/১১ সরকারের সংলাপ
২০০৮ সালের ২২ মে ওয়ার্কার্স পার্টি ও বিকল্প ধারার সঙ্গে সরকারের আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছিলো ১/১১ সরকার। ওই সংলাপ সফল হবে না ব্যর্থ হবে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলেই ছিলো জল্পনা-কল্পনা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে ব্যর্থতার দিকটি আলোচ্য ছিলো।
রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য ও সংলাপের পরিকল্পনা ও বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কাই করা হয়েছিলো। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভিন্নমতের পেছনে যুক্তিসংগত কারণ ছিলো। ১/১১ সরকারের সময় রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি যে বৈরিতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা একটি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অনেকেই মনে করেছিলেন।
সরকারবিরোধী রাজনীতিকরা সরকারের কথা বিশ্বাস করতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। অভিযোগ ছিলো, সরকার এক অংশের রাজনীতি দমন করেছে, অন্যদিকে জনবিচ্ছিন্ন ও দুর্নীতিপরায়ণ অংশকে রক্ষা করেছে।
এই নিবন্ধের লেখকের (শায়রুল কবির খান) ২০০৮ সালের ৫ জুলাই দৈনিক দিনকালে ‘সংলাপ নিয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা’ শিরোনামে এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, যা ছিল তখনকার এক-এগারো সরকারের সময়ে মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিন প্রশাসনের প্রেক্ষাপটে লেখা।
সেই লেখার একটি অংশে উল্লেখ ছিলো, ‘সংলাপের সফলতা নির্ভর করছে নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। সরকার ও রাজনৈতিক দল কেউ-ই একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। জনগণের চাহিদাভিত্তিক সংলাপ সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সরকার সহজ ও গ্রহণযোগ্য পথ অবলম্বনের চেষ্টা করতে পারে।’
ওই লেখায় বলা হয়েছিলো, ‘‘সংলাপ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে দুটি বিষয় বলা যায়: ১) সরকার যদি রাজনৈতিক দলের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে, তাহলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করার দিকেই যাবে। ২) সরকারের স্বার্থ বিবেচনায় একটি রোডম্যাপ অনুসরণ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় নিতে পারে।’’
সেই ১/১১ এর সময়কার রাষ্ট্রনৈতিক বাস্তবতা থেকে কতখানি সামনে এগিয়েছে বাংলাদেশ? বিশেষত রক্তস্নাত ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সামগ্রিক উদ্যোগে?
পরিশেষে বলাই যায়, নাগরিকদের নিজের উপলব্ধি ছাডা শুধু কাগুজে লেখার মধ্য দিয়ে সংস্কার রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব?
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
সারাবাংলা/এএসজি