বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সৈনিক যারা
১৬ এপ্রিল ২০১৯ ১৩:২০
সবার আগে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করে নিউজিল্যান্ড। এরপর গতকাল অস্ট্রেলিয়া ও ভারত তাদের ১৫ সদস্যের বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করেছে। মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) জানিয়ে দেওয়া হলো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দল। এই বিশ্বকাপের চমক হয়ে ইংল্যান্ডের বিমান ধরবেন আবু জায়েদ রাহি। বাদ পড়েছেন পেসার তাসকিন আহমেদ। দলে জায়গা করে নিয়েছেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। গত বিশ্বকাপের স্কোয়াডে থাকা ৮ জন রয়েছেন এবারেও।
আরও পড়ুন- ওয়ানডে বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণা
বিশ্বকাপে নামার আগে আগামী ৫ মে আয়ারল্যান্ডে শুরু হতে যাওয়া ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ নেবে টাইগাররা। যেখানে স্বাগতিক আয়ারল্যান্ড এবং দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ থাকবে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজ শেষ হবে ১৭ মে।
বিশ্বকাপ দল ঘোষণার শেষ তারিখ ২৩ এপ্রিল। তবে ২৩ মে পর্যন্ত দলে পরিবর্তন আনা যাবে। আয়ারল্যান্ড সফর শেষে বিশ্বকাপ খেলতে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখবে গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে লেখা বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপের আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে টাইগাররা। ২৬ মে পাকিস্তান ও ২৮ মে ভারতের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেরই ভেন্যু কার্ডিফ ওয়েলস স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ২ জুন ওভালে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্কোয়াড:
মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক), সাকিব আল হাসান (সহ-অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মোস্তাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, লিটন কুমার দাস, সৌম্য সরকার, রুবেল হোসেন, মেহেদি হাসান মিরাজ, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, মোহাম্মদ মিঠুন, আবু জায়েদ রাহি, সাব্বির রহমান।
বাংলাদেশের হয়ে বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
১। তামিম ইকবাল:
দেশসেরা ওপেনার ও লাল সবুজের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। টিম ম্যানেজেমেন্টের চোখে তার বিকল্প তিনি নিজেই। ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে যার ব্যাট খাপ খোলা তলোয়াড়। দেশটিতে সবশেষ খেলা ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও সে প্রমাণ তিনি দিয়েছেন। ইংলিশদের বিপক্ষে ১২৮ রানের ইনিংসের ঠিক পরের ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেছেন ৯৫ রানের ইনিংস। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করবে তামিমের ভালো খেলার উপরে।
২। লিটন দাস:
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে লিটন দাসের ব্যাটে ধ্বংসের সুর নেই অনেক দিন হলো। জ্বলে ওঠার আগেই দপ করে নিভে গেছেন। তবে এটা ঠিক যেদিন জ্বলে উঠে সেদিন পুড়ে খাঁক হয়ে যায় প্রতিপক্ষের বোলিং লাইন আপ। তাতেই আস্থা রাখছেন টাইগার দলপতি মাশরাফি বিন মুর্তজা। বিশ্বকাপে তিনিও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারেন একথা সেদিন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠেই জানিয়েছেন নড়াইল এক্সপ্রেস। বিশ্বকাপে তামিমের সঙ্গে তার বিধ্বংসী জুটি গড়ার সামর্থ নিয়ে কোনো কথাই হবে না।
৩। সৌম্য সরকার:
বাংলাদেশ দলের তৃতীয় ওপেনার হিসেবে বিশ্বকাপে যাচ্ছেন প্যারিস্কোপ শটের জনক সৌম্য সরকার। যদিও বর্তমান ফর্ম তার পক্ষে কথা বলছে না। প্রিমিয়ার লিগে ব্যাট হাতে নামের সুবিচার করতে পারেননি এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। কিন্তু তাতে কি? নিজের দিনে সৌম্য কতটা ভয়ংকর হতে পারেন সেটা টিম ম্যানেজমেন্ট ভালো করেই জানেন।
৪। সাকিব আল হাসান:
বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণ তিনি। লম্বা সময় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মুকুট একচ্ছত্র দখলে রেখেছিলেন এই টাইগার। যদিও মাস দুয়েক আগে তা হাতছাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু তার মানে তো এই নয়, সাকিব আর সাকিব নেই। টিম ম্যানেজমেন্টর চোখে তিনি সবসময়ই একের ভেতরে তিন। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং; তিন বিভাগেই তিনি সেরা। তাকে ছাড়া বিশ্বকাপ অচিন্তনীয়। সারা দেশ তার পারফরম্যান্সের অপেক্ষায়। বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং, বোলিং সামর্থ নিয়েও কোনো কথা থাকছে না।
৫। মুশফিকুর রহিম:
ব্যাট হাতে লাল সবুজের নির্ভরতার মূর্ত প্রতীক তিনি। দলের ত্রাতা। দলের বিপদে দৃঢ় ব্যাটে হাল ধরে ইতোমধ্যেই ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ তকমা পেয়ে গেছেন মুশফিকুর রহিম। স্ট্রাইক রোটেট করে প্রতিপক্ষের উপর চাপ তৈরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে দেশের হয়ে রান সংগ্রাহকের তালিকায় তিনে থাকা এই ব্যাটসম্যান উইকেটের পেছনেও নিজের যোগ্যতার প্রমাণ করেছেন সমানে। বিশ্বকাপে তার ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।
৬। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ:
‘মিস্টার কুল’ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বিশ্বকাপেও যথারীতি ব্যাট হাতে ৬ এ দেখা যেতে পারে। নিউজিল্যান্ড সফরে টেস্ট সিরিজে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ছন্দে ফেরা এই মিডল অর্ডারের ব্যাটে অধিনায়ক মাশরাফি সবসময়ই ভরসা রাখেন। এবারও নিশ্চয়ই আস্থা রাখা যায় তার উপর। গত বিশ্বকাপেই তো বাংলাদেশের প্রথম কোনো ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন রিয়াদ।
৭। মোহাম্মদ মিঠুন:
ব্যাট হাতে প্রতিভার প্রমাণ দিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্রিকেটের নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেছেন মোহাম্মদ মিঠুন। নিউজিল্যান্ড সফরে ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ধারাবাহিত ব্যর্থতার মিছিলে তার ব্যাটই ধারাবাহিক রান উপহার দিয়েছে। যা বিশ্বকাপে তার জায়গাটি মোটামুটি পাকাপোক্তই করে দিয়েছিল। টিম কম্বিনেশনের খাতিরে মিডল অর্ডার মিঠুনকে কখনো সখনো টপ অর্ডারেও দেখা যেতে পারে বিশ্বমঞ্চে।
৮। সাব্বির রহমান:
লোয়ার মিডল অর্ডারে অধিনায়ক মাশরাফির বাজির ঘোড়া। মাশরাফির ভাষ্যমতে, ‘৪০ ওভারের পরে পেসারদের ১৪৫-১৫০ কিলোমিটার গতির বল সাবলীল ব্যাটে খেলার সামর্থ্য একমাত্র সাব্বির ছাড়া আর কেউই রাখে না।’ তাইতো মাঠে ও মাঠের বাইরে নানা ঘটনায় জড়িয়ে নিষেধাজ্ঞায় থাকা এই ব্যাটসম্যানের এক মাসের শাস্তি কমিয়ে অধিনায়ক নিয়ে গিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ড সফরে। অধিনায়কের আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন বিস্ফোরক ব্যাটেই। ডানেডিনে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে টম লাথামদের বিপক্ষে ১১০ বলে ১০২ রানের ঝলমলে ইনিংসে তুলে নিয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি।
৯। মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত:
ব্যাট হাতে নিদারুণ রান ক্ষরা যাচ্ছিলো তার। তাই তাকে বাদ দিয়ে চমক হিসেবে ইয়াসির আলী রাব্বির নাম শোনা গিয়েছিল। কিন্তু হাঠাৎ করেই রানে ফেরায়, সেঞ্চুরি হাঁকানোয় এবং অভিজ্ঞতার পাল্লায় ভারী হওয়ায় বিশ্বকাপ স্কোয়াডে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের নাম বেশ জোরালো হয়ে উঠেছিল।
১০। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন:
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন বিশ্বকাপ দলে জায়গা পাবেন এটাই মত ছিল বিশেষজ্ঞদের। দলের পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে জায়গা পাওয়ার বিষয়টি বারবারই খালেদ মাহমুদ সুজনের মুখে শোনা গেছে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ব্যাটে বলে ধারাবাহিক পারফর্ম করা সাইফউদ্দিন নিউজিল্যান্ড সফরেও ছিলেন দারুণ ক্ষুরধার। সবশেষ আবাহনী-প্রাইম দোলেশ্বর ম্যাচে ৬ ওভারে ৯ রান দিয়ে দোলেশ্বরের টপঅর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে পাঠিয়েছিলেন সাইফউদ্দিন।
১১। মেহেদি হাসান মিরাজ:
২০১৬ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেকের পর থেকেই টাইগার দলের নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেছেন এই অফস্পিনিং অলরাউন্ডার। মেহেদি হাসান মিরাজ ব্যাট ও বল দুইয়েই দক্ষ। তবে বিশ্বকাপে তার প্রতিটি ম্যাচ খেলা নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ আছে। টিম ম্যানেজমেন্টর দেয়া তথ্যমতে, উইকেট বিবেচনায় তাকে মাঠে নামানো হবে। যেহেতু অফস্পিনার হিসেবে সাকিব থাকছেনই তাই পেস বোলিং অলরাউন্ডারের কোটায় দেখা যেতে পারে সাইফউদ্দিনকে।
১২। মাশরাফি বিন মুর্তজা:
তার ম্যাচ রিডিংয়ে ক্ষমতা অসাধারণ। তার নেতৃত্বেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনাল ও আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমি ফাইনালের মুখ দেখেছে বাংলাদেশ। অনেকেই বলছেন এবারের বিশ্বকাপই মাশরাফির শেষ। তিনিও সেকথা আকার ইঙ্গিতে বলেছেন। তাই যতবারই বিশ্বকাপ নিয়ে তার সঙ্গে কথা হয়েছে ততবারই বলেছেন, ‘আমি চ্যাম্পিয়ন হতেই যাব। বাদ বাকি পরে দেখা যাবে।’
১৩। মোস্তাফিজুর রহমান:
অভিষেকে পর থেকেই বল হাতে সোনা ফলিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘এক্স ফ্যাক্টর’। মাশরাফির বিবেচনায় দেশসেরা পেসার। মাঝে মাঝে ইনজুরি তাকে পেয়ে বসে এই যা। গতি কিছুটা কম হলেও কাটারের ভেলকিতে প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করার ক্ষমতা তার অসাধারণ। তাকে ছাড়া বাংলাদেশ দল! সে তো অসম্ভব।
১৪। রুবেল হোসেন:
ইংল্যান্ডের কন্ডিশনে তিনি প্রমাণিত সৈনিক। গেল বিশ্বকাপেও বল হাতে কাঁপন ধরিয়েছিলেন এই বাটারফ্লাই ডেলিভারির জনক। বাংলাদেশ দলের অভিজ্ঞ এই পেসারকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপ দল ভাবতেই পারেন না মাশরাফি। দলের বিপর্যয়ে ব্রেক থ্রু এনে দিয়ে অনেক আগেই হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ দলের ভরসার পাত্র। ৯৬টি ওয়ানডে খেলে ১২২ উইকেট এই পেসারের দখলে।
১৫। আবু জায়েদ রাহি:
এবারের বিশ্বকাপে চমক বলতে ২৫ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার আবু জায়েদ রাহি। দেশের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ৫টি, উইকেট নিয়েছেন ১১টি। ওয়ানডেতে এখনও অভিষেক হয়নি, কিন্তু পেয়ে গেছেন বিশ্বকাপের টিকিট। টি-টোয়েন্টিতে তিনটি ম্যাচ খেলে উইকেট নিয়েছেন চারটি। প্রথম শ্রেণির ৭৬ ম্যাচে রাহি উইকেট নিয়েছেন ২২৭টি। লিস্ট এ তে ৫৪ ম্যাচে নিয়েছেন ৬৫ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটের নিয়মিত পারফরম্যান্স তাকে বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে দিয়েছে। নির্বাচকদের আস্থা কতটুকু পূরণ করতে পারবেন ইংল্যান্ডের মাটিতে সেটির প্রমাণ মিলবে।
সারাবাংলা/এমআরপি/এসএস/এমআরএফ