ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের লর্ডস
৫ জুলাই ২০১৯ ০৯:২০
একটি ক্রিকেট মাঠ কতটা অভিজাত হতে পারে, কতটা ঐতিহ্যের ধারক হতে পারে ক্রিকেট মক্কা লর্ডসে না এলে সেটা বোঝার উপায় ছিল না।ক্রিকেট বিশ্বকাপের সংবাদ সংগ্রহে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের মোট ৭টি ভেন্যুতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু কোনটিতেই এতটা ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের ছটা দেখা যায়নি। মাঠের প্রতিটি স্থাপনাতেই ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের লেপ্টলেপ্টি।
লর্ডস তার ঐহিত্য দেখায় মূল প্রবেশ পথ থেকেই। লন্ডনের সেইন্ট জনস উড রোড থেকে আপনি যখনই মাঠে প্রবেশ করতে উদ্যত হবেন, নিরাপত্তা তল্লাসির জন্য মিনিট খানেক ব্যয় করতে হবে। এরপর আপনার গন্তব্য জেনে একজনকে ডেকে পাঠানো হবে যিনি আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন। গন্তব্যে পৌঁছামাত্র দেখবেন সেখানে অপেক্ষমানরা আপনার সহযোগিতার জন্য নিয়জিত। যদি বলা নিবেদিত প্রাণ, বোধ করি অত্যুক্তি হবে না। আর আভিজাত্যের ছোয়াঁ অনুভুত হয় মুল প্রবেশ পথ লাগোয়া মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) একাডেমি থেকেই যা শেষ হয় প্রেস বক্স, গ্যালারিতে। আর ঐতিহ্য তার যবনিকা টানে এমসিসি যাদু ঘরে গিয়ে।
মাত্র দুটি পিলারের ওপরে আধুনিক শৈলীর অর্ধ ডিম্বকৃতি প্রেসবক্স আপনাকে বিমোহিত করবেই। লিফট ধরে প্রথম তলার প্রেসবক্সে পা দিতেই আরো অভিভুত হবেন। এ অভিজাত ইন্টেরিয়র আপনাকে নিয়ে যাবে ভাবনার জগতে… এত আধুনিকও হতে পারে! সফেদ চেয়ার টেবিলে বসা মাত্রই নিজেকে লর্ডস,লর্ডস অনুভুতি শুরু হবে।
প্রেস বক্সে বসে যেই মাঠে তাকাবেন মনে হবে, মাঠ নয় যেন সবুজ মখমলের একটি চাদর। এতটা মসৃণ যেন, সুদীর্ঘ্যকাল ব্যাপী কোন দক্ষ কারিগর পরম মমতায় তৈরী করেছেন। বলে রাখা ভাল ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সময় মিডিয়া সেন্টারটি তৈরী করা হয়েছিল। যেখানে একসঙ্গে ১শ সাংবাদিকের কাজের সুযোগ পেয়ে থাকেন।
মাঠের স্ট্যান্ড বা গ্যালারি ৮টি। ভিক্টোরিয়ার এরা স্ট্যান্ড, ওয়ার্নার স্ট্যান্ড, গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড, কম্পটন স্ট্যান্ড, এডরিখ স্ট্যান্ড, মাউন্ড স্ট্যান্ড, ট্যাভার্ণ স্ট্যান্ড ও অ্যালেন স্ট্যান্ড। তবে সবচাই উল্লেখযোগ্যটি ট্যাভার্ণ স্ট্যান্ড। প্রাচীন পাব ট্যাভার্নের নামে ইংল্যান্ডের একদল ক্রিকেটপ্রেমী গ্যালারিটির নামকরণ করেছিলেন। সেই পাবটি (বার) আর নেই কিন্তু গ্যালারিটি ঠিকই সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আর আাভিজাত্যের বিচারে এগিয়ে ভিক্টোরিয়ান আমলের গ্যালারিটি। তার ভাবখানা এমন-সাধারণ কোন দর্শক আমার ধারের কাছেই এস না। তামাম দুনিয়ার কুলিনরা আমাতে বসে ধন্য কর। গ্যালারির প্রতিটি কর্ণারে ধোঁয়া রোধক সিগন্যাল বাতি। ভুল করেও গ্যালারিতে বসে কেউ ধুমপান করলে সেই সিগনাল চিৎকার করে লর্ডসের ঐতিহ্য ভঙ্গের জানান দেবে।
অবশ্য এমনিতেই লর্ডসের আইন কানুন ভীষণ কঠোর। ওভাল কিংবা নটিংহ্যামের মত চাইলেই আপনি স্টেডিয়ামের যে কোন প্রান্তে, কিংবা ভবনে যেতে পারবেন না। সেজন্য অনুমতির প্রয়োজন হয়। এমনকি ছবি তুলতে হলেও! তাছাড়া কুলিনসর্বস্ব এমসিসি সদস্যদের আনাগোনাও যেহেতু থাকে সেহেতু ‘জাত গেল, জাত গেল’ একটি ব্যাপারও এদের মধ্যে প্রবলভাবে কাজ করে। সেজন্যই বোধ হয় এত সতর্কতা।
স্টেডিয়ামের আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু এমসিসি (মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব) যাদুঘর। যা ইংল্যান্ডের হোম অব ক্রিকেটটে দিয়ে দিয়েছে অনন্য এক মর্যাদা। লর্ডসে আসবেন কিন্তু যাদুঘরে যাবেন না, এমন মানুষ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান থেকে থেকে রিকি পন্টিং, স্টিভ ওয়া থেকে শেন ওয়ার্ন, বিখ্যাত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম এখানে সযতনে রাখা হয়েছে। ।
ব্র্যডম্যান এখানে সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছেন। আছেন স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। খুব ছোটবেলায় যখন অ্যান্ডি রবার্টসকে সঙ্গে নিয়ে এই লর্ডসে স্যর অ্যালস গ্রোভারের ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে এসেছিলেন, তখন তাদের দু’জনকেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল,তোমরা অযোগ্য। অ্যান্টিগুয়ায় ফিরে গিয়ে অপমানিত ভিভ এবং রবার্টস যেভাবে গোটা দুনিয়াকে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন, তা অনেকেরই জানা। সেই ছোটবেলায় লর্ডসের আবেদনের সঙ্গে যে ছবি ভিভ পাঠিয়েছিলেন, তা এখনও এই আবেদনপত্রের সঙ্গে সযত্নে রাখা আছে।
ভারত কক্ষে গিয়ে চোখে পড়ল একেবারে মাঝখানে ক্রিকেট ওয়ান্ডার শচীন তেন্ডুলকারের জার্সি। সামনে বিষেণ সিং বেদির অ্যাকশন ছবি। সৌরভ গাঙ্গুলির জার্সি আছে একটি। প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে এসে যে জার্সি পরেছিলেন, সেটি ঝোলানো আছে। রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাট, মহেন্দ্র সিং ধোনির উইকেটকিপিং গ্লাভস, বীরেন্দ্র শেহবাগের প্যাড, কপিলদেবের শোয়েটার, গাভাসকারের স্কাল ক্যাপ— সবই পেলাম, কিন্তু সৌরভ গাঙ্গুলির সেই জার্সিটা কোথায়?যেটা তিনি শরীর থেকে খুলে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উড়িয়েছিলেন।খুঁজে খুঁজে অবশেষে সৌরভের ৯৯ নম্বর জার্সিটি পাওয়া গেল। অন্য এক ক্যাবিনেটে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।
আরো আছে মর্যাদার অ্যাসেজের সেই ছোট পাত্রটি, ভিক্টোর ট্রাম্প, জ্যাক হবস, ডন ব্রাডম্যান, ডব্লিউ জি গ্রেস ও শেন ওয়ার্নের ব্যবহৃত ক্রিকেট সামগ্রীসহ তাৎপর্যপূর্ণ অনেক কিছুই।
লর্ডসে যারা খেলতে আসেন তাদের গর্বের জায়গা ২টি। ড্রেসিংরুম ও অনার্স বোর্ড। এখানকার অনার্স বোর্ডে লেখা আছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তামিম ইকবালের নাম। ২০১০ সালের মে তে এই মাঠেই স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০০ বলে ১০৩ রানের গৌরবান্বিত ইনিংসটি খেলেছিলেন চট্টলার ছেলে তামিম।
লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড সাধারণত লর্ডস নামেই সবার কাছে পরিচিত। লন্ডনের সেইন্ট জোনসএলাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক এই ভেন্যুটি যুক্তরাজ্যের সবচাইতে বড় ক্রিকেট ভেন্যু। বিখ্যাত মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব বা এমসিসির সত্বাধীকারী ও মাঠের প্রতিষ্ঠাতা টমাস লর্ডের নামে মাঠের নামকরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠ তো বটেই মিডল সেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড(ইসিবি) এবং ইউরোপীয় ক্রিকেট কাউন্সিলের সদরদপ্তরও এখানেই। ২০০৫ এর আগস্ট পর্যন্ত আইসিসির সদর দপ্তর ছিল এখানেই।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের মোট ১১টি ফাইনালের মধ্যে চারটিই এই ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৫, ১৯৭৯, ১৯৮৩ ও ১৯৯৯। চলতি বিশ্বকাপের ফাইনালও এখানেই গড়াবে। তার আগে আগামি কাল বিশ্বকাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে এখানে পাকিস্তানের মোকাবেলা করবে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের দর্শকরা বিশ্বকাপের সব ম্যাচ অনলাইনে কোনো ধরনের সাবস্ক্রিপশন ফি বা চার্জ ছাড়াই দেখতে পারবেন র্যাবিটহোলের ওয়েবসাইট www.rabbitholebd.com-এ। এছাড়া র্যাবিটহোলের অ্যাপেও দেখা যাবে প্রতিটি ম্যাচ। অ্যাপটি অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীরা ডাউনলোড করতে পারবেন https://goo.gl/UNCWS2 (শুধুমাত্র বাংলাদেশ) এই লিংকে ক্লিক করে। তাছাড়া আইওএস ব্যবহারকারীরা ডাউনলোড করতে পারবেন https://goo.gl/vJjyyL (শুধুমাত্র বাংলাদেশ) এই লিংকে ক্লিক করে।
আরও পড়ুন: মর্যাদার লড়াইয়ে নামবে বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এমআরএফ/এসএস
ইতিহাস ও ঐতিহ্য ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০১৯ ক্রিকেটের মক্কা বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিশ্বকাপ স্পেশাল লর্ডস