মাশরাফির ব্রেসলেটও পেল আকাশসম সম্মান
১৮ মে ২০২০ ০৩:২৮
বারবার চোটে পড়ে ছুরি-কাঁচির নিচে যেতে যেতে দুই হাঁটুই তার ক্ষতব্ক্ষিত। এক-দুই বার নয়, সাত বার হয়েছে অস্ত্রোপচার। বোলিং মার্কে যাননি ক্যাপ টানতে টানতে। রানআপ নিয়ে পপিং ক্রিজে এসে যখন বল ছোঁড়েন, বোঝাই যায় কতটা কষ্ট তাকে সইতে হয়। অভিব্যক্তিতেই স্পষ্ট— হাত দিয়ে নয়, বল করেন হৃদয় দিয়ে। ক্রিকেটের প্রতি, দেশের প্রতি তার এই হৃদয় নিংড়ানো নিবেদনই তাকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। অর্জন করেছেন ১৬ কোটি মানুষের আকাশ সমান সম্মান। দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কিংবদন্তীদের কাতারে।
বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই কার কথা বলছি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন— তিনি মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। তিনি নিজে যেমন কিংবদন্তী, ঠিক তেমনই তার ১৬ বছরের ব্রেসলিটটিও পেল আকাশ সমান সম্মান।
মাশরাফির এই ব্রেসলেটটি দামি কোনো ধাতুর নয়। স্রেফ স্টেইনলেস স্টিলে গড়া, যা প্রায় ১৬ বছর তার ডান হাতে শোভা পাচ্ছে। ব্যতিক্রম বলতে কেবল তাতে মাশরাফি নামটি খোদাই করা ছিল। মাশরাফির ভাষ্য, তার এক বন্ধুর মামার মধ্যমে পেয়েছিলেন।
দেড় যুগেরও বেশি এই সময়ে স্রেফ ওপারেশন থিয়েটার ও এমআরআই করতে গিয়েই কেবল খুলেছেন ওই ব্রেসলেট। এছাড়া একটিবারের জন্যও সঙ্গছাড়া করেননি। বুঝতে বেগ পাওয়ার কথা নয়, দু’জনের মধ্যেকার সম্পর্ক কতটা নিবিড় ছিল।
কিন্তু করোনাকাল সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। ম্যাশও হঠাৎ করেই সেই দীর্ঘদিনের সঙ্গীকে নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঠিক করলেন, দেশের ক্রান্তিকালে তাকে বিক্রি করে যে টাকা আসবে, তার পুরোটাই দুঃস্থদের মাঝে ব্যয় করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৬ মে দেশের অনলাইন নিলাম প্ল্যাটফর্ম ‘অকশন ফর অ্যাকশনে’ নিলামে তোলা হলো অকৃত্তিম সেই বন্ধুকে। ১৭ মে রাতে তা বিক্রি হল অভাবনীয় মূল্যে। ৪২ লাখ টাকায় ব্রেসলেট কিনে নিলো বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশন (বিএলএফসি)।
প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে লাইভ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মুমিনুল ইসলাম। দাম চূড়ান্ত হলে মাশরাফি তার হাত থেকে ব্রেসলেটটি খুলে ফেলেন। বড় চমকটি আসে তখনই। মুমিনুল জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাশরাফিকে ওটা ‘উপহার’ হিসেবে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তাও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। উদারতা দেখাতে কার্পণ্য করেননি মাশরাফিও। তাৎক্ষণিক জানিয়ে দেন, সেই পর্যন্ত তিনি তা খুলে রাখবেন।
অথচ রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্রেসলেটের বিডিং ছিল ৯ লাখের কিছু ওপরে। রাত ১০টা নাগাদ তা গিয়ে ঠেকল প্রায় ১৩ লাখ ৪০ হাজারে। এতে করে লাল-সবুজের ক্রিকেটানুরাগী ও মাশরাফি ভক্তরা কিছুটা হতাশই হয়েছিলেন। দেশের পতাকবাহী বলে কথা, তার ওপরে আবার মাশরাফি। তার একটি স্মারক এত কম মূল্যে বিক্রি হবে! যেন মেনেই নিতে পারছিলেন না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে লাইভ বিডিং শুরু হলে। রাত সাড়ে ১০টায় তা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও কারিগরি ত্রুটির কারণে তা যখন শুরু হলো, রাত তখন প্রায় পৌনে ১২টা।
লাইভ বিডিংয়ের শুরুতেই একজন দাম হাঁকালেন ১৫ লাখ ৫০ হাজার। নিলামে এক ফাঁকে যোগ দেন তামিম ইকবাল। তার সঙ্গে আলাপের সময় হু হু করে দাম উঠতে থাকে— ১৮ লাখ থেকে ১৯ লাখ ৫০ হাজার, ২৩ লাখ, ৩০ লাখ। এরপর ৪০ ও শেষতক ৪২ লাখ।
ক্রেতা মুমিনুল ইসলাম ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, ব্রেসলেটটি স্রেফ সেইটলেস স্টিলের তৈরি হলেও মাশরাফির সঙ্গে তার সম্পর্কটি আবেগের এবং দেশমাতৃকার স্বার্থেই তা নিলামে তোলার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছেন। কোনোভাবেই তার এই আবেগ আর আবেগের সম্পর্ককে ছোট হতে দেওয়া যাবে না। সে কারণেই সেই আবেগকে জানালেন যথাযথ সম্মান— ৪২ লাখ টাকায় কিনে নিয়ে ম্যাশের ব্রেসলেটকে দিলেন আকাশ সমান সম্মান। আবার সেটি তার কাছেই ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে সম্মান জানালেন ক্যাপ্টেন ম্যাশকেও।