বিশ্বকাপের দল পরিচিতি: সেনেগাল
৭ নভেম্বর ২০২২ ১৯:০১
সেনেগাল ‘গ্রুপ-এ’তে কাতার বিশ্বকাপ খেলবে তাদের গ্রুপের শীর্ষ দ্বিতীয় র্যাংকিংধারী দেশ হিসেবে। নেদারল্যান্ডস এই মুহূর্তে এই গ্রুপের র্যাংকিংয়ের ৮ম স্থানে আছে আর সেনেগাল আছে ১৮তম স্থানে।
আফ্রিকান নেশনস কাপে সেনেগাল গত তিনটি আসরে ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। ২০১৭ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৯ সালের রানার্স-আপ এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে মিশরকে টাই-ব্রেকারে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আফ্রিকান নেশনস কাপ জয়লাভ করে। শুধু তাই নয় কয়েক মাসের ব্যবধানে মিশরকে আবারও বিশ্বকাপ-২০২২ এর বাছাই পর্বে টাইব্রেকারে হারিয়ে বিশ্বকাপের মূলপর্বে ২০১৮’র মতো দ্বিতীয়বারের মতো জায়গা করে নিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে সেনেগাল আফ্রিকার শীর্ষ র্যাংকিংধারী দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে প্রতিনিধিত্ব করবে।
‘লায়ন্স অফ তেরঙ্গা’র এই দলটি বিশ্ব মঞ্চে কি করতে পারে তা দেখার বিষয়। তারা কি ২০০২ সালের মতো আবারও কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারবে? সেনেগালবাসিরা কিন্তু সেই আশায় বুক বেঁধে আছে কারণ ২০০২ সালে তারা আফ্রিকান নেশনস কাপে রানার্স-আপ হয়ে একই সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পেরেছিল। তাদের জন্য আশার আরও কারণ আছে, নাইজেরিয়া ১৯৯৪ এবং ২০১৪ সালে বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডের বাঁধা অতিক্রমকালে ১৯৯৪ ও ২০১৩ সালে আফ্রিকান নেশনস কাপের শিরোপা জয় করেছিল। অন্যদিকে ঘানা ২০১০ সালের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার প্রাক্কালে একই বছরের আফ্রিকান নেশনস কাপে রানার্স-আপ হয়েছিল।
সেনেগাল বা আফ্রিকার অন্য দেশগুলো কেন বিশ্ব ফুটবল মঞ্চে পিছিয়ে আছে—
দারিদ্রতাকে একপাশে রেখে, এই ব্যাপারে যথাযথ বিশ্লেষণ করতে না পারলেও কিছু কিছু বিষয়ের কথা আমরা বলতে পারি। সেনেগাল ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করার ৪২ বছর পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। যেখানে তারা প্রথম ম্যাচেই তাদের কলোনিয়াল প্রভু ফ্রান্সকে পরাজিত করেছিল, যেই ম্যাচে সেনেগালের প্যাট্রিক ভিয়েরা ফ্রান্সের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। ভিয়েরাকে আধুনিক ফুটবলে সেরা একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে গণনা করা হয়। অধুনা আমরা সেনেগাল বা অন্য আফ্রিকার দলের হয়ে খেলতে অনেক ফুটবলারকেই দেখি যারা আসলে ফ্রান্স, জার্মানি বা অন্য কোন ইউরোপীয় দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন।
টেনিসে আমরা দেখেছি খেলোয়াড়রা যে দেশেই জন্মগ্রহণ করেন না কেন, অধিকাংশ খেলোয়াড় ভাল ইংরেজি বলতে পারেন কারণ তারা একটু সুযোগ সুবিধা পেলেই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান উন্নত প্র্যাকটিস সুবিধার জন্য। ঠিক তেমনি মেজর লীগ বেসবল বা ইউরোপের শীর্ষ ফুটবল লীগগুলোতে অনেক ক্লাবকেই দেখা যায় তাদের দলের ১১জন খেলোয়াড়ই বিদেশী, যার মধ্যে আফ্রিকার খেলোয়াড়দের সংখ্যাও কম নয়। শুধু সেনেগালের কথাই বলা যায় তাদের সর্বোচ্চ ৫১ জন খেলোয়াড় ইউরোপের শীর্ষ ৫ ফুটবল লিগে খেলছে এই মুহূর্তে যা আফ্রিকার মধ্যে সর্বোচ্চ, যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আইভরিকোস্ট কষ্টের খেলোয়াড় সংখ্যা হচ্ছে ৩৫ জন।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিভিন্ন দল নিয়ে আমি প্রায় গত ১ মাস যাবত এনালাইসিস করছি, যেখান থেকে দেখতে পেলাম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়রা যারা ইউরোপের বিভিন্ন দিকে ঠেলে থাকেন তারা জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০টি ম্যাচ খেলার পরে যথেষ্ট তরুণ বয়সেই জাতীয় দল থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে নিচ্ছেন। এসবের কারণে রয়েছে দলের ফর্মেশন পছন্দ না হওয়া, কোচ বা কর্মকর্তাদের সাথে মনোমালিন্য, ইউরোপের শীর্ষ দল গুলোর তুলনায় কম সুযোগ-সুবিধা (সেটা প্র্যাকটিস বা আর্থিক যেটাই হোক না কেন) এবং বিশেষত ফেডারেশনগুলোর দুর্নীতির কারণে এসব খেলোয়াড়রা আর জাতীয় দলে খেলতে চান না। তাই আফ্রিকার অধিকাংশ দেশগুলোই শারীরিক বা ফুটবল দক্ষতায় এশিয়ানদের চেয়ে ক্ষেত্রবিশেষে এগিয়ে থাকলেও বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল বা ফাইনাল পর্যন্ত তাদের দেখা যায় না কারণ তাদের অনেক সেরা খেলোয়াড়দেরকে অন্য কোন জাতীয় দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা যায় বা তরুণ বয়সে স্বেচ্ছায় জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে নেন।
সেনেগালের বিগত বিশ্বকাপের পারফরমেন্স—
সেনেগাল এবারের বিশ্বকাপসহ তৃতীয়বারের মতো অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। প্রথমবার ২০০২ সালে বিশ্বকাপে খেলতে এসেই বাজিমাত করেছিল। তারা সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি পৌঁছে গিয়েছিল, যেখানে ইলহান মানসিজের করা অতিরিক্ত সময়ের ৯৪ মিনিটের গোলে তুরস্কের কাছে হেরে গিয়েছিল।
সেনেগাল আগের দুই বিশ্বকাপে ৮টি ম্যাচ খেলে ৩টিতে জয় পেয়েছে, ৩টিতে ড্র এবং মাত্র ২টি ম্যাচে হেরেছে। সেখানে তারা ১১টি গোল করেছে এবং হজম করেছে ১০টি। তাদের হয়ে সর্বোচ্চ ৩টি গোল করেছেন পাপা বউবা দিওপ, যার কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে কারণ ওর করা একমাত্র গোলেই সেনেগাল ফ্রান্সকে ২০০২ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে হারিয়েছিল।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও তারা প্রায় দ্বিতীয় রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। জাপানের সঙ্গে সমান ৪ পয়েন্ট পেলেও ফেয়ার-প্লে নিয়মের বাধায় পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া হয়নি।
কোচ ‘আলিউ সিসে’র ক্যারিশমা—
সেনেগাল যখন ২০১৫ সালের মার্চ মাসে সিসেকে নিয়োগ করেছিল, তখন দেশটির ফুটবলে ভাটা চলছিল। আগের ফ্রেঞ্চ কোচ অ্যালাইন গিরেসের অধীনে সেনেগাল সেই বছরের আফ্রিকান নেশনস কাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল।
২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে অনূর্ধ্ব-২৩ দলের সাথে কাজ করার পর সিসে যখন জাতীয় দলের দায়িত্ব পান, তখন তিনি দেম্বা বা, পাপিস সিসে এবং পাপি ডিজিলোবোদজি সহ কয়েকজন সুপরিচিত খেলোয়াড়কে বাদ দিয়েছিলেন। তিনি সেনেগালকে তার নিজস্ব ইমেজের দল হিসেবে গড়ে তুলতে পছন্দ করেছিলেন– যার অর্থ ছিল সাহস এবং শৃঙ্খলার উপর জোর দেওয়া। তিনি হুক্কা এবং ফ্ল্যাশ ঘড়ি সহ অন্য আইটেম নিষিদ্ধ করেছিলেন, যা নম্রতার অভাব নির্দেশ করতে পারে।
আর এভাবেই তিনি কয়েক দশকের আন্ডারআচিভমেন্টের অবসান ঘটান। ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আফ্রিকান নেশনস কাপ থেকে শুরু করে বিশ্বকাপের পাঁচটি টুর্নামেন্টে খেলার সাথে সাথে চ্যাম্পিয়ন হবারও গৌরব অর্জন করেছে তার দল। যদিও সেনেগাল আফ্রিকান কাপে সিল্কি ফুটবল খেলেনি, কিন্তু দলটি তাদের স্নায়ু ধরে রেখেছিল এবং পর্যায়ক্রমে আত্মবিশ্বাসী দলে পরিণত হয়েছে।
সিসে সিএএফ অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘আমি যখন ২০১৫ সালে তাদের কোচ হয়েছিলাম, তাদের বলেছিলাম যে আমাদের লক্ষ্য আফ্রিকান নেশনস কাপ এবং বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছানো।’ তিনি ইতিমধ্যে এই লক্ষ্যের প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছেন।
২০১৮ বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডে বাদ পড়ার পর তিনি তার ২০০২ বিশ্বকাপের প্রাক্তন সহ-খেলোয়াড় এল-হাদজি ডিউফ ও আমডি ফায়ের সমালোচনার শিকার হলেও ঠাণ্ডা মাথায় তিনি পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দলকে আজকের পর্যায়ে এনেছেন। সাফল্যের এই যাত্রায় তিনি তার সমালোচকদের গঠনমূলক সমালোচনা আমলে নিয়ে সবার সঙ্গেই আলোচনায় বসে দলের করণীয় ঠিক করেছিলেন।
চেলসির গোলরক্ষক এডুয়ার্ড মেন্ডি তার দলের কোচের নেতৃত্বকে পিতা-পুত্রের বন্ধনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। টিম স্পিরিট এবং দলের প্রচেষ্টাকে কোচের নির্দেশনায় বিশেষ করে তোলে বলে প্রশংসা করেছেন।
বিশ্বকাপের গ্রুপ সঙ্গী—
‘গ্রুপ-এ’তে ২১শে নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের সাথে প্রথম ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপের যাত্রা শুরু করবে সেনেগাল। ২৫শে নভেম্বর খেলবে স্বাগতিক কাতারের সাথে আর ২৯শে নভেম্বর হবে তাদের পরম আকাঙ্ক্ষিত ম্যাচ ইকুয়েডরের সাথে।
এবারের বিশ্বকাপে তাদের সম্ভাবনা: বাজির দর: ৯০/১। নেদারল্যান্ডের সঙ্গে সেনেগাল কি করতে পারবে সেই প্রশ্ন বাদ দিয়ে সেনেগাল কি চিন্তা করতে হবে কাতার এবং ইকুয়েডরকে যেন পরাজিত করা যায়। শেষের দুটি দলের সঙ্গে পয়েন্ট হারালেই দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া সংকটে পড়ে যাবে। কাতারের সাথে ইকুয়েডরের র্যাংকিং ব্যবধান হচ্ছে মাত্র ৬ পয়েন্টের (৪৪ ও ৫০), যেখানে সেনেগাল (র্যাংকিং: ১৮) এই দুই দলের তুলনায় এগিয়ে আছে বেশ খানিকটা। দুটি ম্যাচে জয় পেতে তারা তাকিয়ে থাকবে দলের স্ট্রাইকারদের প্রতি কারণ আমরা জানি সিসের অধীনে ডিফেন্সিভ খেলতে পারলেও ম্যাচ জিততে গেলে স্ট্রাইকারদের সাহায্য লাগবেই।
আফ্রিকান নেশনস কাপে সাফল্যের রেশ ধরে দলটি বেশ চাঙ্গা রয়েছে। তাই বিশ্বকাপে তারা দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করবে সেই প্রত্যাশা আমরা করতে পারি।
খেলার ফর্মেশন—
সিসে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলাতে পছন্দ করেন। যেখানে সাধারণত ২জন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের সাথে ২জন উইঙ্গার সাদিও মানেকে সহায়তা করবেন।
দলের শক্তিশালী ও দুর্বল দিক—
সেনেগালের চেলসির গোলরক্ষক এডুয়ার্ড মেন্ডি এবং সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার কালিদৌ কৌলিবলি বিশ্বমানের। বাকি গোলরক্ষক এবং ডিফেন্ডাররা ইউরোপের শীর্ষ লিগে সুনামের সাথে খেলছেন। তাই একসময়ের রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার কাম ডিফেন্ডার সিসের কোচিংয়ে সেনেগাল কি পরিমাণ ভালো রক্ষণ বজায় রাখতে পারে তা সহজেই অনুমেয়, যেটা আরও পরিষ্কার হবে নিচে আমার দেয়া সেনেগালের বর্তমান সেরা একাদশে চোখ বোলালেই।
কিন্তু লেফট-ব্যাকে সমস্যা আছে যেখানে সালিউ সিস, যিনি ২০২১ আফ্রিকান নেশনস কাপে অসামান্য ছিলেন, এই গ্রীষ্মে ৩৩ বছর বয়সে ন্যান্সি ছাড়ার পর থেকে ক্লাব ছাড়া হয়ে পড়েন। তাই এই জায়গা সামাল দিতে হবে ১৪টি ও ২৯টি ম্যাচ খেলা এসি মিলানের ২৫ বছর বয়সী ফোদে ব্যালো টুরে ও রিয়েল বেটিসে খেলা ২৯ বছরের ইউসুফ সাবালিকে।
মিডফিল্ডে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন খেলোয়াড়ের মধ্যে রয়েছেন চেইখৌ কাউয়াতে (নটিংহাম ফরেস্ট), নামপালিস মেন্ডি ও বোবাকারি সৌমারে (লিচেস্টার সিটি) এবং ইদ্রিসা গুয়ে (এভারটন)। সৌমারে ছাড়া সবাই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে প্রসিদ্ধ। এদের মধ্যে কাউয়াতে আবার সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবেও খেলতে পারেন।
ফরোয়ার্ড লাইনে সাদিও মানেকে সমর্থন করার জন্য বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দ্রুত গতি সম্পন্ন ইসমাইলা সার, বোলায়ে দিয়া এবং ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির ফামারা ডিডিইউ। সেনেগাল কাতার বিশ্বকাপে অনেকদূর যেতে পারে যদি তারা একটি ভালো সংমিশ্রণ ব্যবহার করতে পারে, কারণ তাদের প্রতিটি পজিশনে ভালো মানের খেলোয়াড় রয়েছে।
তাদের দলের দুর্বলতার মধ্যে আমার কাছে একটি জিনিস ধরা পড়েছে সেটি হল তাদের দলে বেশ কয়েকজন ভালো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার আছেন, কিন্তু উইংগার বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার পজিশনে অল্প কয়েকজন খেলোয়াড় আছেন যাদের পরিবর্তে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে যারা নামবেন তাদের গুণমানের সংকট আছে।
যাদের দিকে চোখ রাখতে হবে—
এডুয়ার্ড মেন্ডি (গোলরক্ষক, বয়স: ৩০): চেলসি কাস্টোডিয়ান ২০২১ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ এবং উয়েফা সুপার কাপ জিততে সাহায্য করেছিলেন। তার এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সুবাদে জানুয়ারিতে ফিফার সেরা গোলরক্ষক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
কালিদৌ কৌলিবালি (ডিফেন্ডার, বয়স: ৩১): সিসে রাশিয়া বিশ্বকাপের পর ২০১৯ সালে কৌলিবালিকে অধিনায়কত্ব প্রদান করেন। ডান-পায়ের এই সেন্টার-ব্যাক পিচে তার আত্মবিশ্বাস, সময়মতো বাধা এবং কার্যকরী ক্লিয়ারেন্সের জন্য বিখ্যাত। কাউন্টার এটাকের সময়ও তিনি বেশ কার্যকর হয়ে ওঠেন। কঠিন ম্যান মার্কিংয়ে অভ্যস্ত বলিষ্ঠ এবং শক্তিশালী এই ডিফেন্ডারকে পরাজিত করা সহজ নয়।
ইদ্রিসা গুয়ে (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, বয়স: ৩২): তিনি হলেন ‘লায়ন্স অফ তেরঙ্গা’র স্পন্দিত হৃদয়, খেলাটিকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি এর গতি কমিয়ে দিতে সক্ষম। ওভার ল্যাপিং, চূড়ান্ত পাস প্রদান, বল আটকানো ও ট্যাকলিংয়ে জিততে পারার ক্ষমতার সাথে সাথে খেলাটিকে অধ্যয়ন করার একটি অসাধারণ গুন তার রয়েছে ।
নামপালিস মেন্ডি (ডিফেন্স মিডফিল্ডার, বয়স: ৩০): খর্বকায় এই খেলোয়াড়টি প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনি মিডফিল্ডে অতিরিক্ত গতি নিয়ে আসেন। কৌশলগতভাবে নির্ভরযোগ্য মেন্ডির উচ্চ স্তরের স্ট্যামিনা রয়েছে যা তাকে পিচের বিশাল এলাকা কভার করতে সক্ষম করে, বল জয়ের শক্তিশালী দক্ষতা ও প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ সাহায্য করে।
সাদিও মানে (ফরোয়ার্ড, বয়স: ৩০): সাদিও মানেকে কে না চেনে? তিনি সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন। ৩৪.৮৪ কি.মি/প্রতি ঘন্টায় দৌড়ানোর ক্ষমতা তাকে এই গ্রহের দ্রুততম ফরোয়ার্ডদের মধ্যে একজন করে তোলে। অন এবং অফ দ্যা বলে তিনি অত্যন্ত সৃজনশীল, তীক্ষ্ণ এবং উদ্যমী পদ্ধতির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতিরক্ষায় উল্লেখযোগ্য সমস্যা সৃষ্টি করেন। ক্লিনিক্যাল ফিনিশার হিসাবে তার একটি ট্রেডমার্ক দক্ষতা হল লো শটের মাধ্যমে নেটের যেকোনো কোণে ফিনিশিং টাচ দিতে পারেন।
এই বিশ্বকাপের সম্ভাব্য সেরা একাদশ—
গোলরক্ষক: এডুয়ার্ড মেন্ডি (চেলসি)
ডিফেন্ডার: বউনা সার (বায়ার্ন মিউনিখ), চেইখৌ কাউয়াতে (নটিংহাম), কালিদৌ কৌলিবলি (চেলসি), ইউসুফ সাবালি (রিয়েল বেটিস)
মিডফিল্ডার: ইদ্রিসা গুয়ে (এভারটন), পাপে সার (টটেনহ্যাম), ক্রেপিন দিয়াতা (মোনাকো), ইসমাইলা সার (ওয়াটফোর্ড)
ফরোয়ার্ড: সাদিও মানে (বায়ার্ন মিউনিখ) ও হাবিব দিয়ালো (স্ট্রাসবার্গ) ।
আমার দেখা সেরা একাদশ (বর্তমান ও নতুন খেলোয়াড় সহ)—
এই একাদশ আমি তৈরি করেছি যাদের খেলা বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক বা ক্লাব লেভেলে দেখার সুযোগ হয়েছে।
সেনেগাল প্রথম বিশ্বকাপে সুযোগ পায় ২০০২ সালে, যেই বিশ্বকাপে তারা অভিষেকেই কোয়ার্টার ফাইনাল অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমার আজকের একাদশে সেনেগালের বর্তমান সময়ের খেলোয়াড়দের আধিক্য বেশি। কারণ হচ্ছে, সেনেগালের অধিকাংশ খেলোয়াড় বর্তমানে বিশ্বের সেরা লীগগুলোতে খেলে আসছে। সেটা অবশ্য আরও কয়েক দশক আগে থেকেই নিয়মিত ছিল। তবে মজার ব্যাপার হল, যেই সমস্ত খেলোয়াড় ইউরোপের বিভিন্ন লীগে খেলার অভিজ্ঞতা বেশি তারা কিন্তু জাতীয় দলে ৫০-৬০টির বেশি ম্যাচ খেলেননি, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম ম্যাচ খেলে ৩০-৩২ বছরের মধ্যেই সেনেগাল জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ক্লাব ফুটবলে মনোনিবেশ করেছেন।
যাইহোক, এবার খেলোয়াড়দের তালিকায় চোখ দেয়া যাক, যাদের বাছাই করা হয়েছে ৪-৪-২ ফর্মেশনে।
গোলরক্ষক:
এডুয়ার্ড মেন্ডি (ম্যাচ সংখ্যা: ২৫টি। বয়স: ৩০ বছর এবং চেলসির গোল-রক্ষক বর্তমানে জাতীয় দলে রয়েছেন)।
রক্ষণভাগ:
রাইট ফুলব্যাক:
হাবিব বেয়ে (ম্যাচ সংখ্যা: ৩৫টি, গোল: ১টি। ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ লীগে ৩৪২টি ম্যাচ খেলেছেন, যার মধ্যে ১৪৭টি ম্যাচ খেলেছেন অলিম্পিক ডি মার্সেই ক্লাবের হয়ে)।
সেন্ট্রাল ডিফেন্স:
চেখ কুয়াতে (ম্যাচ সংখ্যা: ৮৩টি, গোল: ৪টি। এখনো জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন, বয়স: ৩২ বছর। এ যাবৎ ৪১৫টি ম্যাচ বেলজিয়ামের অ্যান্ডারলেখ্ট এবং ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ওয়েস্টহ্যাম ও ক্রিস্টাল প্যালেসের মত ক্লাবের হয়ে খেলেছেন)।
কালিদৌ কৌলিবলি (ম্যাচ সংখ্যা: ৬৪টি। তিনিও বর্তমানে জাতীয় দলে খেলে যাচ্ছেন, বয়স: ৩১ বছর। এখন পর্যন্ত ৩৪৬টি ম্যাচ ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান এবং ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন। নেপোলির হয়ে ২৩৬টি ম্যাচ খেলে এই সিজনে চেলসিতে যোগদান করেছেন!)
লেফট ফুলব্যাক:
লামিনে দায়াত্তা (ম্যাচ সংখ্যা: ৭১টি, গোল: ৪টি। তিনি ফ্রেঞ্চ লীগে ২০৯টি ক্লাব ম্যাচ খেলেছিলেন)।
মধ্যমাঠ:
রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার:
ইদ্রিসা গুয়ে (ম্যাচ সংখ্যা: ৯৬টি, গোল: ৭টি। ৩৩ বছর বয়সে এখনো জাতীয় দলে খেলে যাচ্ছেন। ফ্রেঞ্চ লীগের লিল, পিএসজি এবং ইংলিশ লীগে এভারটনের মত ক্লাবে এখন পর্যন্ত ৩৩৪টি ম্যাচ খেলেছেন)।
আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার:
পাপা বউবা দিওপ (ম্যাচ সংখ্যা: ৬৩টি, গোল: ১১টি। তিনি ক্লাব লেভেলে ১৭৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ লীগে)।
খালিদৌ ফাদিজা (ম্যাচ সংখ্যা: ৩৭টি, গোল: ৪টি। তিনি বেলজিয়াম, ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ লীগে ১৬৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন)।
ইসমাইল সার (ম্যাচ সংখ্যা: ৪৭টি, গোল: ১০টি। তার বয়স মাত্র ২৪ বছর এবং বর্তমান জাতীয় দলে উইঙ্গার হিসাবে খেলছেন। এখন পর্যন্ত ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ লীগে ১৮৫টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করেছেন)।
স্ট্রাইকার:
সাদিও মানে (ম্যাচ সংখ্যা: ৯৩টি, গোল: ৩৪টি। ৩০ বছর বয়সী সাদিও মানে বর্তমান জাতীয় দলে রয়েছেন। তিনি এখন পর্যন্ত ৩৫৫টি ম্যাচ ফ্রেঞ্চ, অস্ট্রিয়ান, ইংলিশ এবং জার্মান লীগে খেলেছেন। লিভারপুলের সাথে ১৯৬টি ম্যাচে ৯০ গোল করে এই সিজনে তিনি বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দিয়েছেন) &
এল হাদিজ দায়উফ (ম্যাচ সংখ্যা: ৭০টি, গোল: ২৪টি। তিনি ফ্রেঞ্চ, স্কটিশ এবং ইংলিশ লীগে ৩৯৬টি ম্যাচ খেলেছিলেন)।
অতিরিক্ত:
সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার:
আলিওউ সিসি (ম্যাচ সংখ্যা: ৩৫টি। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিদায় নেন এবং ফ্রেঞ্চ ও ইংলিশ লীগে ১৫৩টি ক্লাব ম্যাচ খেলেছিলেন), উইঙ্গার কেইটা বালদে (ম্যাচ সংখ্যা: ৪০টি, গোল: ৬টি। তার বয়স: ২৭ বছর এবং জাতীয় দলে এখনো খেলছেন। তিনি এখন পর্যন্ত ২২৯টি ম্যাচ ফ্রেঞ্চ এবং ইতালিয়ান লীগে খেলেছেন) এবং স্ট্রাইকার হেনরি কামারা (ম্যাচ সংখ্যা: ৯৯টি, গোল: ২৯টি। অবসর নেয়ার আগে তিনি ২২৬টি ম্যাচ ফ্রেঞ্চ, স্কটিশ এবং ইংলিশ লীগে খেলেছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো তিনি ১৯টির মত বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন, যার অর্থ হচ্ছে তিনি ক্লাব লেভেলের চেয়ে জাতীয় দলে বেশি সফল ছিলেন!)।
খেলোয়াড় বাছাই প্রক্রিয়া—
গোল-রক্ষনে টনি সিলভার (যিনি ২০০২ বিশ্বকাপে খেলেছেন এবং জাতীয় দলে ৮৩ টি ম্যাচে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর বাইরে ফ্রেঞ্চ লীগে খেলেছেন ১৮৮টি ম্যাচ) পরিবর্তে এদুয়ার্দ মেন্দিকে নিয়েছি, যিনি কিনা চেলসিতে গত ২ বছর প্রথম পছন্দের খেলোয়াড় হিসেবে খেলছেন এ যাবৎ চেলসির হয়ে ৭১টি ম্যাচ খেলেছেন।
সেনেগালের উইংব্যাক ঐতিহ্যগতভাবে তেমন একটা শক্তিশালী না হবার কারণে আমি বাধ্য হয়ে হাবিব বেয়ের মতো রাইট ফুল-ব্যাককে ২০২২ সালের বিশ্বকাপে রাইট-ব্যাকে খেলা ওমার ডাফ বা ফার্দিনান্দ কলির পরিবর্তে নিয়েছি। ডাফ এবং কলি হাবিবের চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেললেও ক্লাব লেভেলে হাবিব অনেক বেশি ধারাবাহিক ছিলেছিলেন, যিনি কিনা শুধুমাত্র ফ্রেঞ্চ লীগেই খেলেছিলেন ২৮১টি ম্যাচ।
সেন্ট্রাল ডিফেন্সে শেখ কুয়াতেকে আলিউ সিসের (যিনি ২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগালের অধিনায়ক ছিলেন এবং পরে জাতীয় দলের কোচ হয়ে সেনেগালকে ২০২১ সালে ‘আফ্রিকান নেশনস কাপে’র শিরোপা জিতিয়েছেন) জায়গায় নিয়েছি কারণ কুয়াতে সিসের চেয়ে দীর্ঘদেহী, সেন্ট্রাল ডিফেন্স ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশনে খেলতে পারেন এবং জাতীয় ও ক্লাব লেভেলে বেশি ম্যাচ খেলেছেন। আর খালিদু কুলিবালির কথা আর কি বলার আছে, যিনি কিনা কত কয়েক বছর যাবৎ ইতালিয়ান লীগে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন ছিলেন।
আগেই বলেছি রাইট এবং লেফট উইং-ব্যাকে সেনেগালের দুর্বলতা ছিল, তাই আমার যতদূর মনে পড়ে ২০০২ বিশ্বকাপে সেন্ট্রাল ডিফেন্সের বাম প্রান্তে থাকা লামিনে দিয়াতেকেই এই একাদশে লেফটব্যাক হিসেবে নিতে বাধ্য হয়েছি। এই একাদশের ডিফেন্সের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, এদের সবার উচ্চতা ৬ ফুটের উপরে।
ঐতিহ্যগতভাবে সেনেগালের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা হল তাদের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড পজিশন। ইদ্রিসা গুয়ে এই পজিশনে থাকবেন কারণ তিনি গত এক যুগ ধরে ফ্রেঞ্চ এবং ইংলিশ লীগে সুনামের সাথে খেলছেন। মিডফিল্ডে এই একাদশের সবচেয়ে দীর্ঘদেহী ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার পাপা বউবা দিওপকে নিশ্চয়ই সবার মনে আছে, যিনি কিনা ২০০২ সালের বিশ্বকাপে নিজের জন্মভূমি ফ্রান্সকে হারিয়েছিলেন তার করা একমাত্র গোলের সুবাদে। তিনি মিডফিল্ডের রক্ষণাত্মক এবং আক্রমণাত্মক, দুই পজিশনেই খেলতে পারতেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা যান।
মধ্যমাঠের অন্য দুই জায়গায় খালিলু ফাদিগা এবং ইসমাইলা সারকে নিয়েছি। সেনেগালের আরেকটি দুর্বলতা হচ্ছে তাদের দলের মধ্যমাঠে সেই রকম কোন প্লে-মেকার নেই। যদিও ক্লাব লেভেলে ফাদিগা তেমন সফল ছিলেন না কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপে তিনি তার দলের অন্যতম সেরা মধ্যমাঠের খেলোয়াড় ছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান জাতীয় দলের ২৪ বছর বয়সী উইঙ্গার সার ইতিমধ্যে জাতীয় দলের হয়ে ৪৭টি ও ক্লাব লেভেলে ১৮৫টি ম্যাচ খেলে ফেলেছেন।
পক্ষান্তরে স্ট্রাইকার পজিশনে থাকা সাদিও মানে এবং এল হাজি দিয়ুফ হচ্ছে সেনেগালের সর্বসেরা দুইজন খেলোয়াড়। যদিও দিয়ুফ ক্লাব লেভেলে মানের মতো সফল ছিলেন না, কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন সেনেগালের সেরা খেলোয়াড়।
আরও পড়ুন: বিশ্বকাপের দল পরিচিতি: ইকুয়েডর
সারাবাংলা/এসআইটি/এসএস