ফিরে দেখা ২০২৪
ক্রীড়াঙ্গনে অস্থিরতায় পালাবদলের হাওয়া
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:৪৫ | আপডেট: ১ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:১৪
দেখতে দেখতে শেষদিকে ২০২৪ সাল। আর কয়েক ঘণ্টা পরই বদলে যাবে বর্ষপঞ্জিকা। ঘটনাবহুল এই বছরের শেষ দিন পেছন ফিরে দেখে নেয়া যাক দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বাক বদলের মুহুর্তগুলো-
গত ০৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে দেশের সকল ক্ষেত্রেই। বাদ পড়েনি ক্রীড়াঙ্গনও। জুলাই-আগস্ট মিলিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন স্থবিরতা নেমে এসেছিল দেশের খেলাধুলার জগতে। সরকার পতনের প্রভাবে সৃষ্ট অস্থিরতার পর ক্রীড়াঙ্গনে লেগেছে পালাবদলের হাওয়া। বদলে গেছে নেতৃত্ব, সামনে এসেছেন অনেক পুরনো মুখ। ঢেলে সাজানো হয়েছে ক্রিকেট-ফুটবলসহ কাবাডি, হকি, বাস্কেটবল ও অন্যান্য ফেডারেশনকে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক নেতা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া।
বিসিবিতে নতুন নেতৃত্ব
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) ১২ বছরের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। এই এক যুগে বিসিবিতে ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। বলা চলে বিসিবি আর পাপন হয়ে উঠেছিল একে অন্যের সমার্থক। ক্রীড়া সংগঠক ও প্রশাসক পরিচয়ের বাইরে তার রাজনৈতিক পরিচয়ও ছিল। আন্দোলনের মুখে পতিত আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দায়িত্ব পেয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে।
তবে মন্ত্রণালয়ে খুব বেশিদিন দায়িত্ব পালন করা হয়নি পাপনের। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার খাতিরে দেশ ছেড়ে যান তিনিও। তার সাথে হদিস ছিল না বিসিবির সাবেক অনেক দাপুটে পরিচালকেরও। মূলত বিসিবির বিগত পরিচালনা পর্ষদ আওয়ামী লীগ সমর্থিত হওয়ায় সভাপতিসহ ২৫ পরিচালকের বেশিরভাগই চলে যান আত্মগোপনে। নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রন সংস্থাটি। অবশ্য নীতিনির্ধারনী বিষয়ে তিন-চারজন পরিচালকের দিক নির্দেশনায় বেতনভুক্ত কর্মকর্তারা কোনোরকম চালিয়ে নেন কার্যক্রম।
পরিবর্তিত দৃশপটে গত ২১ আগস্ট ই-মেইল যোগে বিসিবিতে নিজের পদত্যাগপত্র পাঠান পাপন। সেদিন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বোর্ড সভাতে ৮ পরিচালকের সম্মতিক্রমে গৃহীত হয় পাপনের পদত্যাগ পত্র। পদত্যাগ করেন আরও দুই পরিচালক খালেদ মাহমুদ সুজন ও নাইমুর রহমান দুর্জয়।
নতুন বিসিবি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। যদিও তাকে সরাসরি সভাপতি করার এখতিয়ার ছিল না বিসিবির। যে কারণে একটু ভিন্ন পথেই হাঁটতে হয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি)। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়কের বিসিবি কাউন্সিরলরশিপ আগেই ছিল। বিসিবির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতি হতে হলে আগে পরিচালক পদে থাকতে হবে। এনএসসি সেদিনই তাকে বিসিবি পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর বিগত বোর্ডের উপস্থিত পরিচালকদের ভোটে সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ফারুক।
এর আগে ১৯ আগস্ট এনএসসি মনোনীত দুই বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুস ও আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববিকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। জালাল ইউনুস পদত্যাগ করলেও আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি পদত্যাগে রাজী হননি। তিনি জানিয়েছিলেন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ চাইলে তাকে অব্যাহতি দিতে পারে। ২১ আগস্ট, বোর্ড সভার পর তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তাদের জায়গায় ক্রীড়া পরিষদ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ফারুক ও নাজমুল আবেদিন ফাহিম।
গত আগস্টের সেই অস্থিরতা পুরোটাই কাটিয়ে উঠেছে বিসিবি। নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে লোকবল সংকট থাকলেও মাঠের ক্রিকেট সেটার প্রভাব পড়েনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাথে মিলে আয়োজন করেছে এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ।
জুলাই আন্দোলনকে উপজীব্য করে ‘তারুণ্যের উৎসব’ থিমে মাঠে গড়িয়েছে একাদশতম বিপিএল। মাসকট উদ্বোধন থেকে শুরু করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে হয়েছে জমকালো কন্সার্ট। যেখানে পারফর্ম করেছেন পাকিস্তানি শিল্পী রাহাত ফতেহ আলী খান। মঞ্চ মাতিয়েছেন বাংলাদেশের জেমস, আসিফ, রাফাদের মতো তারকারাও।
এর আগে এনসিএল টি-টোয়েন্টি, নারীদের প্রথম শ্রেণির লিগও আয়োজন করেছে বিসিবি। এ ছাড়া নারী ক্রিকেটারদের বেতন বাড়ানো, ন্যাশনাল পুলে থাকা নারী ক্রিকেটারদের বেতনভুক্ত করাটাও বিসিবির উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
বাফুফেতে ফিরলেন তাবিথ আউয়াল
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের আলোচিত আরেক ঘটনা বাংলাদেশ ফুটবল ফেড়ারেশনের (বাফুফে) নির্বাচন। গত ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর বদলে গেছে বাফুফের নেতৃত্ব। বাফুফের নতুন সভাপতি এখন তাবিথ আউয়াল। আগের দুই মেয়াদে সহ-সভাপতি ছিলেন সাবেক এই ফুটবলার।
এর আগে চারবারের সভাপতি সাবেক ফুটবলার কাজী সালাহউদ্দিন বাফুফে নির্বাচনে সভাপতি পদে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত জানান। অবসান হয় তার ১৬ বছরের শাসনামলের। তার চেয়ে বেশি সময় বাফুফে সভাপতি ছিলেন না আর কেউই।
গত ০৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদশের ফুটবল সমর্থকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফুটবল আলট্রাস’ সালাহউদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তোলে। দফায় দফায় বাফুফে ভবনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে তৎকালীন সভাপতিকে পদত্যাগের আল্টিমেটামও দেয়। যদিও ১৩ আগস্ট সেই প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেছিলেন, পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না তার। বরং বাফুফে সভাপতি পদে নির্বাচন করবেন আবার। কিন্ত সেই ঘোষণার পর নিজের অবস্থান বদলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত জানান তিনি।
বাফুফে থেকে সালাহউদ্দিনের পদত্যাগের দাবি প্রবল হয়ে উঠে গত কয়েক বছরের আলোচিত কিছু ঘনায়। আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে ২০২৩ সালের এপ্রিলে বাফুফের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় ফিফা। দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম। অর্থ কমিটির প্রধান সালাম মুর্শেদীকেও ফিফা জরিমানা করে ১৩ লাখ টাকা। দেশের রাজনৈতিক চিত্র বদলের পর পদত্যাগও করেন আওয়ামী লিগের নির্বাচিত এই সংসদ সদস্য।
নানান অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত বাফুফের দায়িত্বে এখন তাবিথ আউয়াল। ২০১২ ও ২০১৬ সালে বাফুফের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন সাবেক এই ফুটবলার। ২০২০ সালে একই পদে হেরে যান। সেই নির্বাচনের পর বাফুফেতে পা রাখেননি দীর্ঘ চার বছর। নিয়তিরও কী খেলা! চার বছর পর বাফুফে ভবনে গিয়েছেন, তাও দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ কর্তা হিসেবে, নির্বাচনে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে।
গত ০৬ নভেম্বর নতুন পরিচয়ে বাফুফে ভবনে গিয়ে বেতনভুক্ত ও বাফুফের নতুন নির্বাহী কমিটির সঙ্গে পরিচয় পর্ব সারেন তাবিথ। টানা দ্বিতীয়বার সাফ জিতে আসা নারী ফুটবলারদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বাফুফের সকল স্টাফ, শীর্ষ থেকে শুরু করে ক্লিনার পর্যন্ত সবার সঙ্গে পরিচিতি পর্ব সারেন।
এর আগে নিজের নির্বাচনী ইশতেহারে তাবিথ বলেছিলেন, জাতীয় দলের র্যাঙ্কিং, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সঙ্গে ম্যাচ বাড়ানো, ফুটবলারদের আয়ের উৎস নিশ্চিত করা এবং মাঠে দর্শক ফেরানো হবে তার প্রধান এজেন্ডা।
ইতোমধ্যে সেসব নিয়ে কাজও শুরু করেছে তার অধীনস্থ নির্বাহী কমিটি। তার দায়িত্বের শুরুতেই ফিফা উইন্ডোতে মালদ্বীপের বিপক্ষে দুই ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। শুরু হয়েছে নতুন মৌসুমের ঘরোয়া ফুটবলও। তবে মৌসুমের শুরুটা হয়েছিল বাংলাদেশ ২.০ চ্যালেঞ্জ কাপ দিয়ে। বসুন্ধরা কিংস ও মোহামেডানের মধ্যকার সেই ম্যাচ থেকে প্রাপ্ত সকল প্রাইজমানি গিয়েছিল জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে। এ ছাড়া সাফ জিতে আসা নারী ফুটবলারদের জন্য দেড় কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বাফুফে।
ফেডারেশনে উথালপাথাল
০৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম পাড়ায় অবস্থিত ফেডারেশনগুলোতেও ছিল স্থবিরতা। রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলের পর একযোগে অধীনস্থ ৪৫টি ফেডারেশনের মধ্যে ৪২টির নির্বাহী কমিটি ভেঙে দিয়ে সভাপতিদের অব্যাহতি দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এর আগে আরও দাবা, কাবাডি ও ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতিকে সভাপতিকে সরাসরি অপসারন করা হয়। এরপর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয় অ্যাডহক কমিটি গঠনের। এজন্য গঠন করা হয় পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটি। অ্যাডহক কমিটির নাম প্রস্তাব করতে প্রায় তিন সপ্তাহ সময় নেয় সার্চ কমিটি। ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে ফেডারেশনগুলো। কার্যক্রম না থাকায় বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুধু অফিসে হাজির হওয়াটাই ছিল যেন একমাত্র কাজ।
২০১৮ সালের আইন অনুযায়ী ১৪ নভেম্বর ৯টি ফেডারেশনের বিদ্যমান নির্বাহী কমিটি ভেঙে অ্যাডহক কমিটি ঘোষণা করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। এনএসসি সচিব মো. আমিনুল ইসলামের সাক্ষরকৃত এক প্রজ্ঞাপনে নতুন অ্যাডহক কমিটি পায় হকি, ব্রিজ, অ্যাথলেটিকস, স্কোয়াশ, টেনিস, কাবাডি, বিলিয়ার্ড ও স্নুকার, বাস্কেটবল ও দাবা ফেডারেশন। এই ফেডারেশনগুলোতে ফিরেছেন সাবেক অনেক ক্রীড়া সংগঠক ও খেলোয়াড়েরা।
তবে ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কারের উদ্দেশ্যে গড়া এই ৯ ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সদস্য নির্বাচনে তদবিরের অভিযোগ উঠেছে কয়েক দফায়। অনেক ফেডারেশনের বাদ পড়া সদস্যদের দাবি এনএসসির সার্চ কমিটির প্রস্তাবকৃত নাম থেকে কেবল ২০ শতাংশে এসেছে বদল। ব্রিজ ও কাবাডি ফেডারেশনের সভাপতি পদে যে দুটি নাম প্রথমে ছিল, পরবর্তীতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে সেটি পরিবর্তন করা হয়।
সারাবাংলা/জেটি
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তাবিথ আউয়াল নাজমুল হাসান পাপন বাফুফে বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন (বাহফে) বিসিবি