Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উড়াও শতাবতী (১৮) || মূল: জর্জ অরওয়েল || অনুবাদ: মাহমুদ মেনন


১১ জুন ২০১৯ ১২:৩০

<<শুরু থেকে পড়ুন

আগের অংশ’র পর…

শেষতক কমস্টক দাদু তার টাকাগুলো যদ্দুর সম্ভব সমানভাগে পুত্রকন্যাদের মাঝে বাটোয়ারা করে দেন, সুতরাং লাল ইটের দালানবাড়িটি বিক্রির পর প্রত্যেকের ভাগে মোটাদাগে পাঁচ হাজার পাউন্ড করে পড়ে। আর কমস্টক দাদু ধরাধাম ত্যাগ করতে না করতেই সে অর্থ নষ্ট করার পথে পা বাড়ান তারা। না- কোনো উত্তেজনাকর পথে তাদের সে অর্থ নষ্ট হয়নি। মেয়ে মানুষের পিছনে কিংবা ঘোড়দৌড়ে পয়সা খরচের মতো মনোবল তাদের কারোরই ছিল না। তারা এগুলো স্রেফ খুইয়েছেন ব্যর্থ ব্যবসায়িক লগ্নিতে। একের পর এক ব্যবসা ধরেছেন আর ফালতুভাবে পয়সা খুইয়ে এক-দুই বছরেই তার পাততাড়ি গুটিয়েছেন। এভাবে চলতে চলতে তাদের অর্ধেকেরও বেশিজন কবরে চলে যান জীবনের দ্বারপরিগ্রহণ না করেই। মেয়েদের কেউ কেউ বাবার মৃত্যুর পর মধ্যবয়স পার করে অপ্রত্যাশিতভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন বটে কিন্তু ছেলেরা তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় আয়টুকু করার ব্যর্থতায় ডুবে থেকে বিয়ে করার সামর্থটুকুও কখনো অর্জন করতে পারেননি। গর্ডনের ফুফু অ্যাঞ্জেলা ছাড়া আর কারোরই নিজের একটা বাড়ি বলতে কিছু হয়নি। ইশ্বরের বাস নেই এমন কামরা কিংবা গম্বুজঘরেই তাদের ছিল বসবাস। বছরের পর বছর ফালতু কিন্তু ব্যয়বহুল ব্যামোয় ভুগে তারা অক্কা পেয়েছেন একের পর এক। তবে তার আগে ডাক্তার-বদ্যিতেই খরচ হয়ে গেছে শেষ সম্বলটুকু। কন্যাদের একজনকে, অর্থাৎ গর্ডনের ফুফু শার্লোটকেতো ১৯১৬ সাল নাগাদ ক্ল্যাফামের একটি মানসিক নিরাময় কেন্দ্রেও পাঠাতে হলো। লন্ডনের মানসিক নিরাময় কেন্দ্রগুলোয় বেশ ঠাসাঠাসি! মধ্যবিত্তদের সেগুলোয় বেশ ভীর। যাইহোক ১৯৩৪ সাল নাগাদ ওই প্রজন্মের মোটে তিনজন বেঁচে; একজন শার্লোট ফুফু, যার কথা আগেই বলা হয়েছে, আরেকজন অ্যাঞ্জেলা ফুফু, ১৯১২ সালে কোন এক সুযোগে যিনি কিনে ফেলেছিলেন একখানা বাড়ি ও একটি স্বল্প অংকের ভাতাও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তৃতীয় জন ওয়াল্টার কাকা যিনি এটা ওটা করে পাঁচ হাজার পাউন্ড থেকে নানাভাবে খুইয়ে তখনও কয়েকশ’ পাউন্ড বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।

খাদ্য-বস্ত্রের রেশনিংয়ের মধ্যেই বড় হয়েছে গর্ডন। অন্য কমস্টকদের মতো তার বাবাও ছিলেন একইরকম হতাশ ও হতাশাব্যাঞ্জক একজন মানুষ। মেধা বলতে তার কিছুটা ছিলো বটে, আর একটু সাহিত্যমুখীনও ছিলেন। তবে ওই যে কবি কবি ভাবটা, ওটাই হয়েছে কাল। অর্থ কিংবা অংক দুই তার কাছে ছিলো ভীতির অপর নাম। আর তাকেই কিনা কমস্টক দাদু বানিয়ে ছাড়লেন চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট। নিরুপায় লোকটিকে চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্টের প্র্যাকটিসেও নামতে হলো বটে, তবে অংশীদারিত্বে। ফলে যা হবার তাই হলো। প্রতি এক কিংবা দুই বছরে সে অংশীদারী ব্যবসা ভাঙলো। আর তাতে তার আয় বছরে কভু পাঁচ শ’ কভু দুই শ’তে ওঠানামা করলো। তবে সবসময়ই আয়ের শীর্ষরেখা যে ক্রমশঃ নিম্নগামী ছিলো সেটা নিশ্চিত। এই করতে করতে ছাপ্পান্ন বছর বয়সে তিনি মরেও গেলেন। সেটা ১৯২২ সাল। তার আগে কিডনি রোগের ভোগান্তিটি ভুগে গেছেন বেশ করে টানা কয়েক বছর।

এতকিছুতেও হৃতকৌলিণ্য ফিরে পাওয়া আর তা ধরে রাখার বোধটি কমস্টকদের ছিলো বেশ টানটান। গর্ডনের ‘লেখাপড়া’র পেছনে বড় অংক ব্যয় করা না হলে জাত থাকে না, এমন ভাবনাটাই প্রকট ছিলো তাদের মধ্যে। তাতে ‘পড়ালেখা’র একটা বোবাভুত যেনো চেপে বসেছিলো তার ওপর। দামি স্কুলে তাকে পড়তেই হবে সেই বিবেচনায় বছরে ১২০ পাউন্ড খরচের স্কুলে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। আর বলাই বাহুল্য এই স্কুল ফি যোগাতে বাড়িতে বাকিদের ভয়াবহ ত্যাগস্বীকারের মধ্য দিয়ে যেতে হলো। তাতে অনেকটা বিনা শিক্ষায় থেকে গেলো গর্ডনের বোন জুলিয়া। একটি সস্তা নোংরা ঘিনঘিনে বোর্ডিং স্কুলে তাকে পাঠানো হয়েছিলো বটে, কিন্তু গর্ডনকে যেবছর স্কুলে দেওয়া হলো সেবছরই বোনকে ছাড়িয়ে আনা হলো স্কুল থেকে। ততদিনে তার বয়স ষোলো। গর্ডন ‘ছেলে’ আর জুলিয়া ‘মেয়ে’, আর প্রত্যেকের কাছে এটাই স্বাভাবিক বিষয় ছিলো, ছেলেটির জন্য মেয়েটিই ত্যাগ স্বীকার করবে।

তাছাড়াও পরিবার অনেক আগেই এই সিদ্ধান্তেও পৌঁছে গিয়েছিলো যে, গর্ডন চালাক-চতুর, সুতরাং তাকেই লেখাপড়া চালিয়ে যেতে হবে। নিজের চাতুর্যে গর্ডন বৃত্তি পেয়ে যাবে, উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ে নেবে আর পরিবারের ভাগ্যও গড়বে, এই ছিলো তত্ত্ব। এই বিশ্বাস জুলিয়ার মাঝেই ছিলো সবচেয়ে প্রগাঢ়। লম্বা-হ্যাংলা একটা মেয়ে এই জুলিয়া। উচ্চতায় গর্ডনকেও ছাড়িয়ে। শুকনো মুখ, সরু ঘাঁড়-গ্রীবাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেঢপ লম্বা। যৌবনে মেয়েদের এমন একটা গড়ণ রাজহাঁসকে স্মরণ করিয়ে দেয় বৈকি। তবে মেয়েটি ছিলো বেশ সাদাসিদে আর স্নেহবৎসল। নিজেই ঘরের সব কাজ করতো। ঘর-গৃহস্থের কাজে বেশ পাকা সর্বংসহা এক কন্যা। সেই ষোলোতেই তার মুখচ্ছবিতে ছিলো পাকা গৃহিনীর ছাপ। গর্ডনকে আদর্শবান করে গড়ে তুলতে তার চেষ্টার অন্ত ছিলো না। নিজের শৈশবকে গর্ডনের জন্য তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিলো বটে তারপরেও গর্ডনের জন্য তার যত্নের অন্ত ছিলো না। স্কুলের কাপড়ের ভাঁজ ঠিক থাকছে কিনা সে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। নিজের পকেট মানি বাঁচিয়ে গর্ডনের জন্য বড়দিনের উপহার কিংবা জন্মদিনের উপহার কেনা ছিলো হরবছরের ঘটনা। আর হ্যাঁ এসবের প্রতিদান তো গর্ডন দিয়েছেই। একটু বড় হতেই সে বুঝে গিয়েছিলে জুলিয়া সরল, অচতুর, রূপহীন তাকে ঠকানো যায়। রেটিংয়ে তৃতীয় স্তরের যে স্কুলটিতে গর্ডন পড়তো সেখানেরও সব ছেলেই ছিলো তার চেয়ে ধনি পরিবারের। ওরা ‍খুব দ্রুতই গর্ডনের দরিদ্রদশা জেনে যায়, আর বলাই বাহুল্য সেজন্য তাকে সব ধরনের হেনস্ত করতে কেউ কসুর করেনি। কোনও একটি শিশুকে তার চেয়ে ধনীদের সাথে একই স্কুলে পাঠানোর চেয়ে নিষ্ঠুরতা আর কিছুই হতে পারে না। একটি শিশু তার দরিদ্রদশার যে বেদনা ভোগ করে তার বিন্দুমাত্র উপলব্দি করা কোনও বয়ষ্ক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই দিনগুলোতে, বিশেষ করে প্রিপারেটরি স্কুলের দিনগুলোয় গর্ডন মনে মনে ভাবতো যতটা গরিবীহাল তাদের সংসারে সে দেখছে মূলত ততটা গরিব তারা নয়। আহা! দিনগুলোয় যে কতভাবে হেনস্ত তাকে হতে হয়েছে! কত কষ্ট যে পেয়েছে! বিশেষ করে ওই জঘন্য দিনগুলো যেদিনগুলোয় তাকে সবার সামনে প্রধান শিক্ষকের হাতে স্কুল ফি তুলে দিতে হতো। সে যত টাকা আনতে পারতো তা ছিলো নির্দিষ্ট ফি’র চেয়ে কম। আর সে জন্য তাকে কথা শুনতে হতো। প্রধান শিক্ষকের কথাগুলোর চেয়েও তার কাছে কষ্টদায়ক হয়ে উঠতো সহপাঠীদের নিষ্ঠুর হাসি। আবার যখন অন্যরা বুঝে ফেলতো গর্ডনের পরিধানের স্যুটিটি স্রেফ পয়ত্রিশ শিলিং দরের রেডিমেড, তখন তার মরমে মরে যেতে ইচ্ছা করতো।

পরের অংশ>>

সারাবাংলা/এমএম

উড়াও শতাবতী গর্ডন কমস্টক জর্জ অরওয়েল মাহমুদ মেনন


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর