সিনেমা : আমদানিতে সুখ, রপ্তানিতে দুঃখ
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৭
রেজওয়ান সিদ্দিকী অর্ণ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে বহুমুখী সংকট তৈরী হয়েছে। ভালো সিনেমা তৈরী না হওয়া, প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হওয়া থেকে শুরু করে যৌথ প্রযোজনা ও আমদানিকৃত সিনেমা। এসব সংকটের মুখে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গন।
নিয়ম না মেনে নির্মিত যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নিয়ে আন্দোলন করেছে চলচ্চিত্র পরিবার। তাদের আন্দোলনের ফলে তথ্য মন্ত্রণালয় যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার সংস্কার করেছে। এতে করে চলচ্চিত্র পরিবার আনন্দিত হলেও, খুশি হয়নি নিয়মিত যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ করেন যারা। তাদের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্র প্রদর্শক ও পরিবেশক সমিতি। শুধু তাই নয়, সিনেমা আমদানি করার পক্ষে অবস্থান তাদের। তাদের যুক্তি, যৌথ প্রযোজনা কিংবা আমদানি করা সিনেমার কারণে দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো বাঁচবে। লোকসানে পড়তে হবে না হল মালিকদের।
আরও পড়ুন : সেরা হলো বাংলাদেশী ও রোমানিয়ান সিনেমা
যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার কারণে কলকাতার সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ কমে গেছে। অনেক ছবি প্রথমে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হলেও যৌথ প্রযোজনার নীতিমালার দেয়াল টপকানোর ভয়ে সেগুলো ভারতীয় ছবি হিসেবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে। সেসব ছবির মধ্যে রয়েছে ‘ইন্সপেক্টর নটি কে, ‘সুলতান’, ‘চালবাজ, ‘ভাইজান এলো রে’।
সার্কভুক্ত দেশগুলো ব্যবসার স্বার্থে ২০০৪ সালে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা হয়। এই চুক্তিকে বলা হয় সাফটা চুক্তি। ২০০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সাফটা কার্যকর হয়। এই চুক্তির আওতায় ভারত থেকে সিনেমা আসছে এদেশে। ভারত ছাড়া সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের ছবি আমদানি করার নিয়ম থাকলেও কেবলমাত্র কলকাতা থেকেই আমদানি করা হচ্ছে ছবি।
একদম প্রথম দিকে কলকাতার ছবি কলকাতায় মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পর বাংলাদেশে মুক্তি পেতো। তবে বাংলাদেশের কোন ছবি সেখানকার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা শোনা যায়নি বললেই চলে। আর মুক্তি দেয়া হলেও, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কোনো গ্রামে নাম মাত্র মুক্তি দেয়া হয়েছে। এসব নিয়ে বাংলাদেশের ছবি রপ্তানিকারকরা কখনও উচ্চবাচ্য করেন না।
এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে কলকাতার সাথে একই দিনে টালিগঞ্জের ছবি মুক্তি পাচ্ছে। সবশেষ (১০ আগস্ট) মুক্তি পায় ‘পিয়ারে’। মুক্তি পেতে যাচ্ছে শাকিব খান অভিনীত ‘নাকাব’ ছবি। বোঝা যাচ্ছে কলকাতার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো চাইছে একই দিনে দুই বাংলায় ছবি মুক্তি দিতে।
আরও পড়ুন : শিল্পী সংস্থার দুই দিনের রবীন্দ্র-স্মরণানুষ্ঠান
এভাবে দুই বাংলায় একই দিনে ছবি মুক্তি বাংলাদেশের ছবির জন্য হুমকি কিনা জানতে চাইলে চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, ‘কলকাতার ছবি যদি একই দিনে দুই বাংলায় মুক্তি পায় তাহলে আমার মনে হয় এটা এদেশের সিনেমা ব্যবসায় ক্ষতি করবে। এর ফলে কৌশলে কলকাতার ছবি বাংলাদেশে বাজার তৈরী করে ফেলবে। কলকাতার সঙ্গে আমাদের মিলেমিশে কাজ করতে আপত্তি নেই। তারা যেমন সুযোগ নেবে, আমাদেরও তেমন সুযোগ দিতে হবে। আমদানির বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া ছবি সেদেশে মুক্তি পাচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকে গেছে। এটা পরিস্কার হওয়া উচিত।’
পূর্ব ঘোষিত যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলোর দাপ্তরিক অনুমতি পেতে অনেক সময় লাগায় সেগুলো ভারতীয় ছবি হিসেবে আমদানি করা হচ্ছে। এবিষয়ে ফারুক আরও বলেন, ‘এটা খুবই অন্যায় কাজ। ঢালাওভাবে ছবি মুক্তি পাওয়া ঠিক হচ্ছেনা। এতে করে বাংলাদেশের ছবির ব্যবসায়িক পরিবেশ আরও খারাপের দিকে যাবে। এভাবে চলতে দেয়া ঠিক হবেনা।’
বাংলাদেশে কলকাতার ছবি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম আরাধনা এন্টারপ্রাইজ প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কার্তিক দে একই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘কলকাতা থেকে আমদানিকৃত ছবি ঠিকমতো চলছেনা এখানে। আহামরি ব্যবসা হচ্ছেনা। আমরা লাভের জন্য সিনেমা আমদানি করি। বাংলাদেশে বছরে যে কয়টা সিনেমা নির্মিত হচ্ছে, সেই সংখ্যক ছবি দিয়ে টিকে থাকা সিনেমা হলগুলো বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা। আমরা চেষ্টা করছি সিনেমা হল বাঁচাতে। আমাদের এই চেষ্টা যদি সফল না হয় তাহলে আমরা নিজেরাই পিছিয়ে আসবো সিনেমা আমদানি থেকে। যতদিন সরকারী অনুমোদন থাকবে ততদিন আমরা ছবি আমদানি করব। সিনেমা হল তো বাঁচাতে হবে।’
আরও পড়ুন : ‘শাহেনশাহ’র চমকে এভ্রিলকে এগিয়ে রাখছেন নেটজেনরা, তবে…
কলকাতা ছাড়া সার্কভূক্ত অন্যান্য দেশের ছবি কেনো আমদানি করা হচ্ছে না? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘কলকাতার ছবির সঙ্গে আমাদের ভাষার মিলের কারণে ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানি করছি। নেপালের ছবি এখন ভালো হচ্ছে। কিন্তু তাদের ভাষার সঙ্গে আমাদের মিল নেই। পাকিস্তানের ছবিও আমরা আমদানি করব না।’
কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত ছবিগুলো মুক্তির কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। কেন? উত্তরে কার্তিক বলেন, ‘সেখানে বাংলাদেশের সিনেমার বাজার নেই কলকাতার সিনেমা ব্যবসায়ীরা ছবিগুলো মুক্তি দিতে চায়না। আয়নাবাজি সেখানে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। ছবিটা মোটামুটি ভালো চলেছে। ভালো ছবি না হলে চলবে কিভাবে?’
এদিকে পরিচালক সমিতির সভাপতি ও সেন্সর বোর্ডের সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার কলকাতার সঙ্গে একই দিনে ছবি মুক্তির ব্যাপারে কোন আপত্তি দেখছেন না। তবে কলকাতায় রপ্তানি করা বাংলাদেশের ছবি মুক্তি না পাওয়া নিয়ে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু ভারতীয় বাংলা ছবি আমদানি করে মুক্তি দেবো, কিন্তু সেখানে আমাদের ছবি মুক্তি পাবেনা, এটা তো হতে পারেনা। এটা আমাদের সিনেমার জন্য ক্ষতি। সেজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।’
আরও পড়ুন : দুই যুগ পর একসঙ্গে অভিনয়
আজ (৪ সেপ্টেম্বর) তথ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি। গুলজার বলেন, ‘কলকাতায় বাংলাদেশের রপ্তানি করা ছবির সেন্সর কপি যেন আমাদের দেখানো হয়-এমন নির্দেশনা দিতে তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছি। তাহলে আমরা বুঝতে পারব আদৌ সেখানে বাংলাদেশের ছবি মুক্তি পাবে কিনা! এক তরফা শুধু আমদানি করে আমাদের কোন লাভ হচ্ছেনা। আশাকরি তথ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে খুব শিগগিরই নির্দেশনা দেবে।’
সুতরাং দেখা যাচ্ছে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সবাই চান দেশের সিনেমা শিল্পের অবস্থা আরও ভালো হোক। কিন্তু ভিন্ন পথ আর ভিন্ন মত এক নাহলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এভাবে ধুঁকতেই থাকবে বলে মনে করেন চলচ্চিত্র শিল্পের বরেণ্য ব্যক্তিরা।
সারাবাংলা/আরএসও/পিএ
দেখুন সারাবাংলা’য় আড্ডা >>>
https://www.youtube.com/watch?v=LtQWltCxTCU&t=7s