Saturday 06 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বমি দিয়ে তৈরি হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি পারফিউম!

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৩৩

ভাবুন তো, খুব সাজগোজ করে প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। চুলে হালকা ওয়াক্স, হাতে ঘড়ি, আর পোশাকে ঝকঝকে আত্মবিশ্বাস। বের হওয়ার ঠিক আগে যা সবচেয়ে জরুরি— একটু পারফিউম! সেই এক ফোঁটা স্প্রে’তেই ব্যক্তিত্ব যেন অন্য রকম হয়ে যায়।

কিন্তু যদি বলি, আপনার শরীরে যে দামী সুগন্ধ ভাসছে— তা তৈরি হয়েছে বমি থেকে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভুল শুনেননি। বিশ্বের সবচেয়ে দামি কিছু পারফিউম তৈরি হয় তিমি মাছের বমি, অর্থাৎ অ্যাম্বারগ্রিস থেকে।

এই রিপোর্ট শোনার পর অনেকেই হয়তো পারফিউম হাতে নিয়ে একটু ভেবে দেখেছেন— ‘এই জিনিসটা সত্যিই বমি থেকে?’ চমকে উঠবেন না, কারণ গল্পটা আরও মজার!

বমি নয় ‘ভাসমান সোনা’

বিজ্ঞাপন

তিমির এই বমির বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাম্বারগ্রিস। শুধু বমি বললে এর গুরুত্ব কিন্তু বোঝা যায় না। এটা এতটাই মূল্যবান যে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন— Floating Gold বা ‘ভাসমান সোনা’!

কারণ খুব অল্প পরিমাণ অ্যাম্বারগ্রিসই আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হয় লাখ লাখ টাকা, কখনো কোটি টাকাতেও। বেশিরভাগ সময় এই পদার্থ সমুদ্রে ভেসে তীরে চলে আসে, তাই একে অনেকেই ‘সমুদ্রের লটারি’ও বলেন।

তিমি— ডাইনোসরের চেয়েও বড়!

এই অ্যাম্বারগ্রিস আসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী—নীল তিমি বা কখনো স্পার্ম হোয়েল থেকে।

আকারে ডাইনোসরের চেয়েও বড়! দৈর্ঘ্য প্রায় ১০০ ফুট! ওজন ২০০ টন পর্যন্ত হতে পারে! এমনকি এর জিভই একটি হাতির সমান ওজনের! এদের বিশাল শরীরে তৈরি হয় এই আশ্চর্য উপাদান।

কীভাবে তৈরি হয় অ্যাম্বারগ্রিস? গল্পটা একটু অদ্ভুত…

তিমি সাধারণত সমুদ্রে নানা রকম সেফালোপড জাতীয় প্রাণী—যেমন স্কুইড বা অক্টোপাস—খেয়ে থাকে। এদের দেহের কিছু অংশ হজম না হলে তিমির অন্ত্রে জমে কড়া, মোমের মতো কঠিন পদার্থ তৈরি হয়। একসময় তিমি এটি শরীর থেকে বের করে দেয়—এটাই অ্যাম্বারগ্রিস।

এটি দেখতে—
ধূসর বা কালো,
পাথর বা মোমের গাঁটের মতো,
কখনো কখনো খুব দুর্গন্ধযুক্ত,
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এটি পরিণত হয় মূল্যবান সুগন্ধি উপাদানে।

গন্ধটা মদের মতো? নাকি কাদার মতো?

অ্যাম্বারগ্রিসের গন্ধ নিয়ে মজার এক ব্যাখ্যা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন— প্রথমে গন্ধ হয় কিছুটা মলের মতো, পরে তা রূপ নেয় কাদামাটির মতো ঘ্রাণে, শেষ পর্যন্ত পানির ঠান্ডায় পাথরের মতো হয়ে গেলে তৈরি হয় সুগন্ধি তৈরির জন্য আদর্শ উপাদান।
এত অদ্ভুত পরিবর্তনের পরই এটি থেকে আসে দামী পারফিউমের লম্বা, গভীর, স্থায়ী সুগন্ধ।

পারফিউমে কেন ব্যবহার করা হয়?

যারা পারফিউম ভালোবাসেন তারা জানেন— সব পারফিউম একই রকম নয়।
কিছু গায়ে লাগালে গন্ধ ঘন্টা খানেকেই উধাও হয়ে যায়। আর কিছু থাকে—দিনভর, কখনো কাপড়ে লাগলে কয়েকদিনও! আর এই দীর্ঘস্থায়িত্বের রহস্যই অ্যাম্বারগ্রিস।

পারফিউমে অ্যাম্বারগ্রিস যোগ করলে—
গন্ধ দীর্ঘক্ষণ থাকে,
সুগন্ধ মোলায়েম হয়,
শরীরের তাপের সঙ্গে মিশে গন্ধ আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে,
Channel, Dior, Creed— এমন অনেক ব্র্যান্ড এখনও উচ্চমূল্যের পারফিউমে এই উপাদান ব্যবহার করে থাকে (কখনো সিনথেটিক বিকল্পও)।

শুধু পারফিউম নয়— ওষুধেও ব্যবহার!

অ্যাম্বারগ্রিস শুধু সুগন্ধিতেই নয়, প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়েছে—
শক্তিবর্ধক ওষুধে, হজম শক্তি বাড়াতে, যৌন সমস্যার চিকিৎসায়। একসময় মধ্যপ্রাচ্যে অ্যাম্বারগ্রিস ছিল রাজকীয় উপাদান। রাজারা এটি খাবারেও ব্যবহার করতেন বিশেষ ভেষজ হিসেবে।

শুনে অবাক হচ্ছেন? হতেই পারে—কারণ কে-ই বা ভেবেছিল বমি এত মূল্যবান হতে পারে!

অবৈধ শিকার— সমুদ্রের লুকানো বিপদ

অ্যাম্বারগ্রিসের দাম বেশি হওয়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অবৈধভাবে তিমি শিকার করে। যদিও বেশিরভাগ দেশে তিমি শিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, তবে চাহিদা বেশি হওয়ায় দায়ে অনেকেই ঝুঁকি নেন।

মূলত বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশবিদদের মতে— অ্যাম্বারগ্রিস কেবল তখনই সংগ্রহ করা উচিত যখন এটি প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রে ভেসে তীরে আসে।

সমুদ্রে লটারি— হঠাৎ কোটিপতি!

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেলে, পর্যটক বা সাধারণ মানুষ হঠাৎ তীরে অ্যাম্বারগ্রিস পেয়ে কোটিপতি হয়ে গেছেন— এমন গল্পও রয়েছে। কারণ ১ কেজি অ্যাম্বারগ্রিসের দাম কখনো ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্তও হতে পারে! যদি কোনো মৎস্যজীবী এক টুকরো অ্যাম্বারগ্রিস পান… তো বিষয়টা সত্যিই লটারি পাওয়ার মতো।

আপনি যে পারফিউম ব্যবহার করেন— তাতে কি আছে অ্যাম্বারগ্রিস?

সব পারফিউমে অবশ্য অ্যাম্বারগ্রিস থাকে না। বেশিরভাগ ব্র্যান্ড এখন সিনথেটিক বা কেমিক্যাল বিকল্প ব্যবহার করছে, কারণ—
অ্যাম্বারগ্রিস পাওয়া কঠিন,
দাম খুব বেশি,
তিমি শিকারের নিষেধাজ্ঞা,
আন্তর্জাতিক আইনগত জটিলতা,
তবে কিছু বিলাসবহুল ব্র্যান্ড এখনও অ্যাম্বারগ্রিসের সুগন্ধ ধরে রাখার চেষ্টা করে।

যদি আপনার পারফিউম খুব দীর্ঘসময় গন্ধ ছড়ায়— তাহলে সম্ভবত তাতে অ্যাম্বারগ্রিসের ছোঁয়া আছে… বা এর কৃত্রিম সংস্করণ।

বমির গল্পেও রয়েছে সৌন্দর্য!

সুগন্ধির দুনিয়া সত্যিই রহস্যময়। যে গন্ধ আমাদের আকর্ষণীয় করে তোলে, সেই গন্ধের মূল উপাদান যে তিমির বমি—এটা প্রথম শুনলে একটু অদ্ভুত লাগতে পারে।

কিন্তু বিজ্ঞানের অদ্ভুত রসায়নে এই বমিই হয়ে ওঠে— দামী, পছন্দের ও দীর্ঘস্থায়ী
সুগন্ধির মূল রহস্য।

পরের বার প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে পারফিউম লাগানোর সময় মনে পড়ে যাবে— ‘এতো সুন্দর গন্ধ… এর উৎস কিন্তু বেশ অদ্ভুত!’

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর