Sunday 07 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নির্দোষ জর্জ স্টিনি জুনিয়র! মৃত্যুর ৮ দশক পরও যে প্রশ্নগুলো তাড়া করে

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:২১

মানবিকতা, ন্যায়বিচার আর সভ্যতার বড়াই করে আমরা আজ আধুনিক। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা আছে, যেগুলো মনে করিয়ে দেয়— সময়ের ক্যালেন্ডার পাল্টালেও মানুষের ভেতরের অন্ধকার কখনও কখনও অমোচনীয়। ১৯৪৪ সালের আমেরিকার দক্ষিণ ক্যারোলিনায় ঘটে যাওয়া এক নির্মম বিচারবিভ্রাট— ১৪ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর জর্জ স্টিনি জুনিয়রের মৃত্যু— আজও সেই স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।

একটি শিশু, একটি বাইবেল, আর এক ঝড়— যা শুধু একটি পরিবারকে নয়, আমেরিকার বিচারব্যবস্থার বিবেককে তছনছ করে দিয়েছিল।

শুরুর গল্প

মার্চ, ১৯৪৪। দক্ষিণ ক্যারোলিনার আলকোলু নামের শান্ত শহরটির দুপুর অন্যদিনের মতোই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিকেলের আগেই দুই শিশু— ১১ বছরের বেটি জুন বিকারস এবং ৭ বছরের মেরি এমা থেমস— হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা পরে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায় বাড়ির পাশেই, মাথায় আঘাতের চিহ্ন।

বিজ্ঞাপন

হত্যা তদন্তে খুব বেশি সময় ব্যয় হয়নি। পুলিশের নজর যায় পাশের কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক পরিবারের এক ছেলের দিকে— ১৪ বছরের জর্জ স্টিনি জুনিয়র। অভিযোগ? নাকি সুবিধাজনক বলি? সে সময়ের আমেরিকায় এই দুইয়ের ব্যবধান অনেকটাই অস্পষ্ট ছিল।

২ ঘণ্টার ট্রায়াল, ১০ মিনিটের রায় ‘মৃত্যুদণ্ড’

আজকের চোখে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, ইতিহাস বলছে— স্টিনির বিচার প্রহসনের চেয়েও কম কিছু ছিল না। সমস্ত জুরি ছিলেন শ্বেতাঙ্গ। মাত্র ২ ঘণ্টা শুনানি। রায় ঘোষণা করতে সময় লাগল মাত্র ১০ মিনিট।

কিশোরের পাশে ছিল না কোনও আইনজীবী, ছিল না তার বাবা-মা। তাদের কোর্টরুমে ঢুকতেও দেয়া হয়নি; অতিরিক্ত ‘ঝুঁকি’— এই ছিল অজুহাত। বরং স্টিনির পরিবারকে উল্টো হুমকি দেয়া হয়েছিল, শহর ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল।

জর্জ স্টিনি পুরো সময়টাই নিজের নির্দোষত্ব প্রার্থনা করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় কোনও আইনজীবী উপস্থিত ছিল না— তাকে একা ঘরে ঢুকিয়ে জেরা করা হয়েছিল। পুলিশ বলেছিল— সে নাকি স্বীকার করেছে। কিন্তু সেই ‘স্বীকারোক্তির’ কোনও লিখিত নথি নেই, আজ পর্যন্তও পাওয়া যায়নি।

৮১ দিনের একাকীত্ব

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগের ৮১ দিন— জর্জ বন্দি ছিল একটি সলিটারি সেলে। বয়স মাত্র ১৪, কিন্তু তাকে রাখা হয়েছিল বড়দের কারাগারে। নিজের বাড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও মেলেনি।

ট্রায়ালের দিন থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত স্টিনির হাতে ছিল কেবল একটি বাইবেল। সেটিই ছিল তার একমাত্র সঙ্গ।

কেমন ছিলো মৃত্যুদণ্ড

ইলেকট্রিক চেয়ারে বসানোর মতো বড় ছিল না জর্জ। তাকে বেঁধে রাখতে চেয়ারটিতে বাড়তি বই গুঁজে দিতে হয়েছিল। তারপর ৫৩৮০ ভোল্ট বিদ্যুৎ তার ক্ষুদ্র দেহকে অচেতন করে দেয়— আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু। সে আমেরিকার ২০শ শতকের সবচেয়ে কম বয়সী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষ।

৭০ বছর পর প্রমাণ হলো— সে নির্দোষ

সাত দশক পরে, ২০১৪ সালে, দক্ষিণ ক্যারোলিনার এক জজ মামলাটি পুনরায় পর্যালোচনা করে বিস্মিত হন। প্রথমেই নজরে আসে খুনি সন্দেহে উদ্ধার করা ১৯ কেজির লোহার বীম। একটি ১৪ বছরের বালক এটি তুলতেই পারবে না— এমন প্রমাণই ফরেনসিকভাবে নিশ্চিত হয়।

আরও উঠে আসে— পুলিশের জেরা ছিল ভয়ভীতি ও চাপের উপর ভিত্তি করা, জুরিদের সিদ্ধান্ত ছিল বর্ণবাদী পক্ষপাতের সম্পূর্ণ প্রতিফলন, কোনও শারীরিক প্রমাণই স্টিনির বিরুদ্ধে ছিল না। অবশেষে ২০১৪ সালে জর্জ স্টিনি জুনিয়রকে সরকারিভাবে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়।

এই ঘটনা থেকে জন্ম নিল সাহিত্যিক বিদ্রোহ

জর্জ স্টিনির এই বাস্তব ট্র্যাজেডি একসময় পৌঁছে যায় লেখক স্টিফেন কিং এর মনেও। এই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি সৃষ্টি করেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য গ্রীন মাইল’, যেখানে মৃত্যুদণ্ড, বর্ণবাদ, নিষ্ঠুর প্রশাসন এবং মানবিকতার সংঘর্ষ— সবই ভেসে ওঠে ভীষণ তীব্রতায়।

মানবিকতার দাবিতে আমরা কি সত্যিই এগিয়েছি?

অনেকে বলেন— আগের সময়ে মানুষ নাকি বেশি মানবিক ছিল। ইতিহাসের দিকে তাকালে বুঝতে কষ্ট হয় না— এটি নিছকই রোমান্টিক কল্পনা। বর্ণবাদ, পক্ষপাত, ক্ষমতার অপব্যবহার— এই অন্ধকারগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেনি; শুধু আলোয় এসেছে। আগে লুকিয়ে থাকত, এখন প্রকাশ্যে হয়— পার্থক্য শুধু এটাই।

জর্জ স্টিনি জুনিয়রের মৃত্যু তাই শুধু একটি মামলার গল্প নয়— এটি একটি ভাবনার আয়না। মানুষের রঙ, অবস্থান, পরিচয়— এসবের বাইরে যে ন্যায়বিচার দাঁড়ায়, সেই বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেয় তার পরিণতি।

ছোট্ট একটি নাম, বড় একটি শিক্ষা

জর্জ স্টিনি ছিলো নিরপরাধ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বর্ণবাদী সময়ের তৈরি এক সাজানো গল্প। তার মৃত্যুকালীন বয়স মাত্র ১৪— যে বয়সে শিশুদের হাতে স্কুলব্যাগ থাকা উচিত, বিচারব্যবস্থার নয়।

৮১ বছরের দীর্ঘ যন্ত্রণার পর ফিরে পাওয়া বিচার হয়তো পরিবারের ক্ষত সারাতে পারে না। কিন্তু ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়— ন্যায়বিচার বিলম্বিত হলেও, সত্য একসময় উঠে আসে।

তথ্যসূত্র: ভিন্টেজ নিউজ

বিজ্ঞাপন

দাম্পত্য রাগ! সামলাবেন কিভাবে?
৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৫৫

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর