Tuesday 17 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ম্যুরালে হেসে ওঠে সুদর্শনের মুখ


১৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:১৭ | আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৮ ২২:২৯
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ছবি আঁকাটা ছিল স্বপ্ন। ছোটো বেলায় মাটিতে, ঘরের বেড়ায়, কাগজে যেখানেই ইচ্ছে হতো সেখানেই খেয়াল খুশিমত ছবি আঁকতাম। ছবির ফ্রেম কিংবা রঙ বোঝার বয়স তখনও আমার হয় নি। শত অনটনের মধ্যেও ছবি ছিল আমার ধ্যান-জ্ঞান। এখন ছবির সঙ্গেই থাকি। ছবিতেই স্বপ্ন আঁকি।’ এভাবেই বলছিলেন জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড-এনসিটিবির নিজস্ব শিল্পী সুদর্শন বাছার। ম্যুরালে নিখুঁত ছোয়া আর শৈল্পিকতায় এরই মধ্যে তিনি নজর কেড়েছেন বোদ্ধা মহলে। একেরপর এক দৃষ্টি নন্দন ম্যুরাল বানিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন সারাদেশে।

সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিলের এনসিটিবি ভবনের নিজ কার্যালয়ে সারাবাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাতকারে জীবনের গল্প বলেন তরুণ এ চিত্র শিল্পী। তিনি জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০০৮ সালে এনসিটিবিতে চাকরি শুরু করেন তিনি। সেই থেকে পাঠ্যপুস্তকে ছবি এঁকে যাচ্ছেন। বিশেষ করে প্রতিটি বইয়ের প্রচ্ছদ তিনিই আঁকছেন।

বিজ্ঞাপন

পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ম্যুরালের মাধ্যমে প্রথম ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন শরীয়তপুরের কবি অতুল প্রসাদ সেনের ম্যুরাল নির্মাণের পর। এ প্রসঙ্গে সুদর্শন বলেন, জেলার নড়িয়া উপজেলার নীলগুন গ্রামে আমার বাড়ি। কাঞ্চনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে কবি অতুল প্রসাদ প্রতিষ্ঠিত পঞ্চপল্লী গুরুরাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৯৭ সালে এসএসসি পাশ করি। ঢাকায় পড়াশুনার সময় ওই স্কুলেই কবি অতুল প্রসাদের একটা ম্যুরাল করার শখ ছিল। একবার সে সুযোগ এসে যায়। ২০১৫ সালে অতুল প্রসাদ সেনের ম্যুরালটি স্থাপনের পর পুরো এলাকায় হৈচৈ পড়ে যায়। অনেকেই আমার শিল্পকর্মের প্রশংসা করেন।

এরপর গোপালগঞ্জ জেলাপ্রশাসকের উদ্যোগে প্রথমে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ম্যুরালটি বানাই। পরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও বানাই সেখানে। সেই থেকে একের পর এক ম্যুরাল বানাচ্ছি। প্রসংশা পাচ্ছি। সর্বশেষ এনসিটিবি ভবনে বঙ্গবন্ধুর ৭-ই মার্চের ভাষণে মুর‌্যালটি একমাস দশদিন ধরে তৈরি করি। রাত-দিন কাজ করতে হয়েছে।

শৈশবে লেখাপড়া শিখতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, বলেন সুদর্শন। ‘আমার পরিবার ছিল চরম দরিদ্র। আমরা পাঁচ ভাই সবাই লেখাপড়া করতাম। আমি বাবার সঙ্গে বাদাম বিক্রি করেছি। চটপটি বিক্রি করে পরিবারে তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছি। বাবা ভানু বাছারের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে জিলাপি বিক্রি করতাম। রাতে বাড়িতেই জিলাপি বানাতাম, ভোর হলে মাথায় করে নিয়ে ছুটতাম বাড়ি বাড়ি। এককেজি জিলাপিতে ৬কেজি ধান পেতাম। তাই দিয়েই বছরের অনেকটা সময় চলে যেতো আমাদের।’

তিনি বলেন, আমার মা পারুল বাছারও বাবার সঙ্গে সমানতালে কাজ করতেন। কিন্তু তাতেও আমাদের সংসার ভালোভাবে চলতো না। মা রাতে উঠোনে হোগলা বুনতেন। আমরা সেই হোগলার চাটাইয়ের ওপর বসে কূপির আলোয় পড়তাম। ঘরে কোনো চেয়ার টেবিল ছিলোনা। তবে পড়াশুনায় খুব ভাল ছিলাম। সব সময় ক্লাসে প্রথম হতাম।

 

পাঁচ ভাইয়ের লেখাপড়া চালাতে গিয়ে একসময় বাবা বসতবাড়ির কিছু অংশ বিক্রি করে দেন জানিয়ে সুদর্শন বলেন, এসএসসি পরীক্ষার সময় আমার মা একজনের কাছ থেকে এক হাজার টাকা সুদে আনেন। কিন্তু পরে সে টাকা বেড়ে কয়েকগুন হয়। শত কষ্টের মধ্যেও আমরা কোনো ভাই-ই পড়াশুনা ছাড়িনি। এরপর নড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তি হই। আমি কোনোদিন প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ে পড়িনি।

চারুকলায় সিরামিক্স বিভাগে যারা পড়ে তাদের অনেকে পিছিয়ে পড়া হিসেবে মনে করে মন্তব্য করে সুদর্শন বলেন, দ্বিতীয় বর্ষে পড়া অবস্থায় পুরো চারুকলায় আমার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। একটি গ্লাস কোম্পানি আমাকে ডিজাইনার হিসেবে পার্টটাইম কাজ করার অফার দেয়। আমি মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকায় সেখানে কাজ শুরু করি। মূলত বাংলাদেশের গ্লাস শিল্পের যে শৈল্পিক পরিবর্তন যা আগে চীনের দখলে ছিলো তা আমাদের হাত ধরেই আসে। এখন এদেশের গ্লাস শিল্প এদেশীয় শিল্পীরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

 

পেশাগত জীবনে সুদর্শনের পদার্পন খুব বেশি দিনের নয়। কিন্তু এরইমধ্যে তার খ্যাতি ছড়াচ্ছে চারিদিকে। মিডিয়া বেস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং যুবক সিরামিক্স অ্যাওয়ার্ডের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন মহলের প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি। হাজার হাজার প্রতিযোগির মধ্যে তার ডিজাইনের ‘শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ-শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’ মনোনীত হয়েছে। এর মাধ্যমে সারাদেশের ঘরে ঘরে যেমন তিনি পৌঁছে গেছেন। তেমনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ভবন কিংবা জেলা-উপজেলার বিভিন্ন প্রবেশ দ্বারে তার হাতের নিখুঁত স্পর্শে মানব-মহামানবদের ম্যুরাল যখন হেসে উঠেন তখন হেসে উঠেন শিল্পী তরুণ সুদর্শন বাছারও।

সারাবাংলা/এমএস/জেডেএফ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর