মাকে মনে পড়ে…
২০ জানুয়ারি ২০১৮ ১৪:১৭
সাদাত হোসাইন
এক
কমলাপুর রেল স্টেশন। সাপের পিঠের মতন কনকনে ঠাণ্ডা। মেঝেতে ঝিম মেরে বসে আছে সাগর। পিঠের দিকটায় চটের বস্তাটা আরেকটু টেনে তোলে সে। রাতে যখন শেষ ট্রেনটা যায় তারও ঘণ্টাখানেক পরে স্টেশনের বারান্দার এই খাঁজটাতে শুতে পেরেছে সে। পুলিশের লাঠিপেটা থেকে বাঁচতে ২ টাকার ছেঁড়া ন্যাতন্যাতে ৫টা নোট তাকে গুনতে হয়েছে। কিন্তু এত হিম-ঠাণ্ডা! আক্ষরিক অর্থেই হাড়ে হাড়ে টের পায়, ভয়াবহ ঠাণ্ডা পড়েছে এবার।
‘কাকভোরের’ কথা না জানলেও এই জমাট অন্ধকার কুয়াশায় থপ করে যখন একটা কাক তার পাশে এসে বসে, সাগর টের পায়, ভোর হতে দেরি নেই আর! হঠাৎ মেঝেতে কান পাতে সে, তারপর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায়। বস্তাটা খুলে হাতে নিয়ে ছুটতে শুরু করে প্লাটফর্মের দিকে, ট্রেন আসছে… ট্রেন আসছে…! একটা মাল টানার কাজ তাকে বাগাতেই হবে।
দুই
আব্দুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের ঝুপড়ি চায়ের দোকানের পাশে বসে থাকে সাগর। একটাও ‘মুটে’ টানার কাজ পায়নি আজ। দুপুরের দিকে একটা মালবাহী ট্রেনের ছাদে করে আরও কয়েকজনের সাথে সে-ও চলে আসে এখানে। শীতের দুপুরটা হুট করে ক্লান্ত বিকেল হয়। কিন্তু একটুও ক্লান্ত হয় না সাগরের পেটের ভেতর ক্রমাগত অস্থির হতে থাকা ইঁদুরগুলো। ঝিম মেরে বসে থাকে সে।
দুটো কুকুর ঘুরঘুর করে চায়ের ঝুপড়ি দোকানটার চারপাশে। হঠাৎ বাসি এক টুকরো পাউরুটি কুকুরগুলোর দিকে ছুড়ে মারে দোকানী। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ায় সাগর, ছোঁ মেরে তুলে নেয়, তারপর গিলে ফেলে গোগ্রাসে। দু গ্লাস পানি খেতেই পেটের ভেতর অস্থির ইঁদুরগুলোর ঘুমুতে যাওয়া টের পায় সে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে সাগরের। উঁচু দালানের ফাঁক গলে বিকেলের মিষ্টি রোদ যেন আদুরে উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরে তাকে। সামনেই পড়ে থাকা বিশাল টায়ারটার ভেতর গুটিসুটি মেরে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সাগর টের-ই পায় না। টায়ারটাও যেন মায়ের পরম উষ্ণতায় বুকের ভেতর আগলে রাখে তাকে।
ঘুমন্ত সাগরের ক্লান্ত বুকে তৃষ্ণারা কি তখন ফিশফিশ করে বলে… মাকে মনে পড়ে…! মাকে মনে পড়ে…!!
সাদাত হোসাইন : লেখক ও নির্মাতা