Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারী তুমি বিকশিত হও নিজ পরিচয়ে

সানজিদা খান রিপা
৬ মার্চ ২০২২ ২১:৩৩

মানুষ পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই পরিবার থেকে তাকে একটি নাম দেওয়া হয়। এই নাম তার পরিচয় তুলে ধরে—যাতে পৃথিবীর বুকে সে নিজের পরিচয়ে বেড়ে ওঠে। পরিচয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু, নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায় তার নামটি একসময় হারিয়ে যায়। অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে নামের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়।

আমার বাসায় একসময় বয়স্ক একজন নারী কাজ করতেন। আমি সাধারণত বুয়া বলে কখনো সম্বোধন করি না। কাজের শুরুতেই আমি নামটি জেনে নেই এবং সবসময় তাদের নাম ধরেই ডাকাডাকি করি। আমি লক্ষ্য করেছি, নাম ধরে ডাকলে তাদের চোখমুখে একরকম ভালো লাগা ফুটে ওঠে। তবে, বয়স্ক কেউ হলে আমি নামের সঙ্গে খালা শব্দটি যোগ করি। যাইহোক, এই খালা যেদিন আমার বাসায় প্রথম কাজে আসেন তখন আমি তার কাছে নাম জানতে চাই। কিন্তু, তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে হেসে বলেন, “খালা আমি তো নাম বুইল্লা গেছি। অহন বয়স হইছে। অত কিছু আর মনে রাখবার পারি না। তয়, আমার বড় পোলার নাম আজগর। সবাই আমারে আজগরের মা কইয়া ডাকে।”

বিজ্ঞাপন

অবাক আমি, ভেবে পাই না একজন মানুষ কিভাবে তার নাম ভুলে যায়। আসলে সে কি ভুলে গেছে, না আমরা তাকে ভুলে যেতে বাধ্য করেছি। এই সমাজ তো তাকে প্রথমেই পরিচয় দিয়েছে ইদ্রিস মিয়ার বউ। তারপর আজগরের মা। নিশ্চয়ই জন্মের পর তার মা-বাবা তাকে সুন্দর একটি নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ওই নামটি আজ তার কাছে মৃত। উৎসুক মন আমার তাকে আরও জেরা করে। জানতে চাই তার জাতীয় পরিচয়পত্র আছে কি না। তার ভাই বোন কেউ আছে কি না। কোথায় থাকে তারা, যোগাযোগ আছে কি না। কিন্তু, কোনো সদুত্তর আমি তার কাছ থেকে পাইনি। বরং, সে যা শুনিয়েছিল আমাকে, তাতে করে মানুষ হিসেবে মানুষকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তা নারীর প্রতি অন্য এক বঞ্চনার, শঠতার কাহিনী।

বিজ্ঞাপন

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে তরুণী কন্যার পরিচয় হয় বউমা, বা বড় বউ, মেঝ বউ, ছোট বউ এবং স্ত্রী হিসেবে। শহুরে পার্টিতেও দেখা যায় নারীর পরিচয় হয় মিসেস অমুক বা ভাবী হিসেবে। এবং এই ভাবী সম্বোধনের আগে হাজব্যান্ডের সারনেইমটি যুক্ত করে “রহমান ভাবী” হিসেবে পরিচিতি পান। আবার, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর নারীর পরিচয় হয়ে যায় ওমুকের মা, অর্থাৎ, সন্তানের মা হিসেবে তার পরিচয় মুখ্য হয়। আর বিয়ের আগে অমুকের বোন, তার ভাবী, তার মামি/চাচি, তার ননদ ইত্যাদি পরিচয়ে একসময় নারীটির যে একটা নিজস্ব নাম আছে সেই নামটাই ভুলে যান অনেকে। বিষয়টি এ সমাজে অ্যাকসেপ্টেড। অধিকাংশই কিছু মনে করে না এতে। বিষয়টিকে তারা স্বাভাবিক হিসেবে মনে করেন। তারা ভাবেন, এমনটাই তো হবে। কিন্তু কেন এমন হবে—প্রশ্ন করলেই এমনভাবে তাকিয়ে থাকেন যে, মনে হয় আমি ভিনগ্রহের এলিয়েন। এমনকি অনেক নারী বিষয়টিকে এনজয় করে। জন্মানোর পর থেকে পুরুষের ওপর নির্ভর করে বেড়ে ওঠা নারী হয়তো তারা সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে আটকে গিয়ে যুগ যুগ ধরে চলা এই চর্চাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েই একরকম আত্মসুখ খুঁজে পায়।

অথচ, নাম হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটবেলা থেকে গড়ে তোলা তার স্বপ্নগুলোও কিন্তু একসময় হারিয়ে যায়। সমাজের নিয়ম, চর্চা তার স্বপ্নগুলোকে ভুলে যেতে বাধ্য করায়! হুট করে পাওয়া এই পরিচয় সমাজ কি তার উপর চাপিয়ে দেয়—নাকি সে নিজে থেকেই বেছে নেয়!

একবার বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণে গিয়ে এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম। বন্ধুটি তার স্ত্রীকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সন্তানের মা হিসেবে। উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চপদে কর্মরত আমার বন্ধুটি বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখে। হাজার বছরের কাঠামোগত সমাজ সংস্কারের দেয়াল ভেদ করে নারীর নিজস্ব পরিচয়কে সে তুলে ধরতে পারে না অবচেতনভাবেই। কারণ, বিষয়টি যে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা চর্চার বহিঃপ্রকাশ, এটা মানতেই নারাজ তিনি এবং তার মতো উচ্চশিক্ষিত আরও অনেকে।

শেক্সপিয়রের নাটকে যখন ম্যাকবেথের স্ত্রী নামহীন লেডি ম্যাকবেথ হয়ে থাকে এবং তাদের শিক্ষায় আমাদের শিক্ষিত করা হয়, সে সমাজে নারীমুক্তি সুদূরপরাহত। এখনো তো আমরা নারীকে ‘মহিলা’ বলি। “মহল” থেকে “মহিলা” শব্দটির উৎপত্তি। অর্থাৎ, যারা অন্তঃপুরের বাসিন্দা। তাহলে নারী কী এখনও অন্তঃপুরের চার দেয়ালে আবদ্ধ এক প্রজননক্ষম বহুকোষী জীবমাত্র? রাস্তাঘাটে হাটে বাজারে– প্রায় সর্বত্র সবার মুখেই এই “মহিলা” শব্দটা শুনতে শুনতে আমরা বেশ সয়ে গেছি। বাসের গায়ে লেখা থাকে, “মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সিট।” এমনকি যে আইনের বলে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে সেই আইনটির শিরোনামেও “মহিলা” শব্দটি রয়েছে। সেখানে সংরক্ষিত নারী আসনের পরিবর্তে “সংরক্ষিত মহিলা আসন” বলা আছে।

আপনি হয়তো বলতেই পারেন যে “কই আমার স্ত্রী তো কোন কমপ্লেইন করে না, আমি তো তাকে রাফির মা (লেখার প্রয়োজনে এই নামটি ব্যবহার করেছি) বলেই ডাকি। এটা যার যার বিষয়। কেউ হয়তো পছন্দ করতেই পারে।”

অবশ্যই কারো পছন্দ নিয়ে বা ভালোলাগা নিয়ে কোনো কথা নেই। কিন্তু, কথা হলো আমরা কতোটা সচেতন থাকি নিজের পরিচয় নিয়ে! পুরুষশাসিত এ সমাজে একজন নারীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় আর মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসা শিকড়ের ন্যায় তার পরিচয় হয় একজনের মা, বউ হিসেবে এবং আমৃত্যু সে এই পরিচয় নিয়েই বাঁচে। মৃত্যুর পরও বলা হয় অমুকের মা বা স্ত্রী মারা গিয়েছে।

এক বন্ধুর কাছে শুনেছি, আগে আদমশুমারি করার সময় গ্রামের বহু নারী বলতে পারেনি তার নিজের নাম। কোনো কোনো বৃদ্ধ ভুলেই গিয়েছিল তাদের নিজেদের নাম। অনেকে নিজের নাম মনে করতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ত। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে নারী পৌঁছে বাপ-ভাই, স্বামী ও সন্তানের পরিচয়ের উপর ভর করে। কী নির্মম!

সমাজে নারী-পুরুষ সকলেরই নিজস্ব পরিচয় থাকা প্রয়োজন। নিজ পরিচয়ে এগিয়ে চলুন। আপনার পরিচয় আপনার অবস্থান শক্ত করবে। নিজের শক্তি ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে নিজ নামে এগিয়ে চলুন। নিজেকে দুর্বল নয়, শক্তিশালী ভাবুন— চিন্তা ও চেতনায়।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর