শুভ্র শরতে দুর্গার পদধ্বনি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:১৩
।।মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: শরতের শুভ্রতার সঙ্গে শারদীয় দুর্গাপূজার একটা অদ্ভুত মিল আছে হয়ত। তা না হলে বিকেলের আকাশে যখন তুলোর মতো সাদা মেঘগুলোকে উড়তে দেখি তখন শৈশবের পূজা দেখার দিনগুলোর কথা মনে পড়বে কেন? ষড়ঋতুর এ দেশে শরত আসে বরষার রিনিঝিনি শেষে। বরাবরের মতো আসে দুর্গা পূজাও। এবারও প্রকৃতিতে শরতের শুভ্রতার সঙ্গে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা।
আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে দুর্গাপূজা। শেষ হবে ১৯ অক্টোবর। এরই মধ্যে পূজার আগমনী বাদ্য বাজতে শুরু করেছে রাজধানীর পাড়া মহল্লায়। গ্রামে গ্রামে পূজার আমেজ শুরু হয়েছে প্রতিমা ঘরে। সেখানে দিনরাত চলছে প্রতিমা গড়ার কাজ। রাজধানীতেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি পূজা মণ্ডপে চলছে মা দুর্গাসহ অন্যান্য প্রতিমা গড়ার কাজ। মাটি দিয়ে পরম যত্নে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত তারা। সেইসঙ্গে পুরো পূজামণ্ডপ ঘষেমেজে ঝকঝকে-তকতকে করার কাজও চলছে।
আগামী ৮ অক্টোবর শুরু হবে মহালয়া। এর আগেই মণ্ডপগুলোয় উঠতে নতুন প্রতিমা। পূজারিদের মধ্যে আসল পূজার আমেজ বিরাজ করবে সেদিন থেকেই।
রাজধানীর প্রধান পূজা মণ্ডপ ঢাকেশ্বরী মন্দির। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরের বিশাল অঙ্গন ঝকঝকে-তকতকে। কোথাও কোথাও ধোয়ামোছার কাজ চলছে। তবে ঢাকা মহানগর পূজা কমিটি যে স্থানটিতে পূজার আয়োজন তার ঠিক পাশেই গড়া হয়েছে নতুন প্রতিমা। প্রতিমার গায়ে সর্বশেষ তুলির আঁচড় দেওয়া হয়নি। তাই সেগুলোকে পর্দার আড়ালে রাখা হয়েছে। সবগুলো প্রতিমা চূড়ান্তরূপে আসতে আরো অন্তত সপ্তাহখানেক সময় লাগবে বলে জানালেন সেখানকার পুরোহিত বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী।
তিনি বলেন, ‘দিন যত ঘনিয়ে আসছে মণ্ডপকেন্দ্রিক পূজার ব্যস্ততা ততই বাড়ছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে প্রতিমাগুলোর কাজ শেষ হবে। এখন বৌদ্ধ পূর্ণিমা চলছে। এ পূর্ণিমায় হিন্দুদের তেমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই।’
বরাবরের ন্যায় এবারও ঢাকেশ্বরীর প্রতিমা গড়ছেন মানিকগঞ্জের প্রতিমা কারিগর নারায়ণ চন্দ্র পাল। এবারও মণ্ডপে কার্তিক, গণেশ, লহ্মী, সরস্বতী, দুর্গা, ও মহিশাসুরের প্রতিমা বানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে কার্তিকের বাহন ময়ূর, গণেশের বাহন ইদুর, দুর্গার বাহন সিংহ, সরস্বতীর বাহন হাঁস ও লক্ষীর বাহন পেঁচা বানানো হয়েছে।
ঢাকেশ্বরীর পুরোহিত বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী জানান, এবার মা দুর্গা ধরনীতে আসবেন ঘোটক বা ঘোড়ায় চড়ে। আর বিদায় নেবেন দোলায় চড়ে। এবারের পূজার মূল বার্তা ছত্রভঙ্গ। মা দুর্গা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নবকিছু লণ্ডভন্ড করে দিয়ে দুনিয়ায় আসবেন। স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে ছন্দপতন হিসেবে এ ছত্রভঙ্গকে বোঝানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এ পুরোহিত। এটা ঘোড়ায় চড়ে আসার ফল।
যাবেন দোলায় চড়ে। যার ফল হলো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, পোকা-মাকড়, রোগ-জীবানুসহ যাবতীয় অনিষ্টকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন দুর্গতি নাশিনী মা দুর্গা। পরের একটি বছর সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির অবারিত দুয়ার খুলে মা দুর্গা বিদায় নেবেন বিজয়া দশমীতে।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে ‘দুর্গা ষষ্ঠী’, ‘মহা সপ্তমী’, ‘মহাষ্টমী’, ‘মহা নবমী’ ও ‘বিজয়া দশমী’ নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় ‘দেবীপক্ষ’। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন হিন্দুরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এদিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়।
ঢাকার পূজোয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপাল থেকেও আসেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় প্রতি বছর জাঁকজমকভাবে পূজা উদযাপনটি বিদেশিরা বেশ উপভোগ করেন বলে জানালেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পরিচালক রীতা চক্রবর্তী।
তিনি বলেন, ‘কেবল তাদের দেশ থেকে লোকজন আসেন বিষয়টি এমন নয়। আমাদের দেশ থেকেও অনেক লোক ভারতে গিয়ে থাকেন। মূলত পূজাকে কেন্দ্র দুইদেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় বন্ধন তৈরি হয়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালসহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে উদযাপিত হয়ে থাকে। তবে বাঙালি হিন্দু সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের উদযাপিত পালিত হয়। এমনকি ভারতের অসম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মণিপুর এবং ওড়িশা রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে উদযাপিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবাসী বাঙালি ও স্থানীয় জনসাধারণ নিজ নিজ প্রথামাফিক শারদীয়া দুর্গাপূজা ও নবরাত্রি উৎসব পালন করে।
বাংলাদেশে দুর্গাপূজা সার্বজনীন ও হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয়ানুষ্ঠান হলেও ভারতে দুর্গার আধিপত্য কেবল আটটি রাজ্যে। বাকি রা্জ্যগুলোতে অন্যান্য দেবদেবীর পূজা হয়। তবে কলকাতায় প্রথম দিকে ধনী পরিবারগুলোয়ই দুর্গাপূজা উদযাপিত হত। তখন এর নাম ছিলো বনেদি বাড়ির পূজা। যদিও কালের বিবর্তনে এ পূজা সাধারণ শ্রেণির মধ্যেও চলে আসে। হয়ে ওঠে সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসব।
ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সার্বজনীন পূজা শুরু হয়। মূলত দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারনা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরম গানটি রচনা করেন যা ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিল্পবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।
আরও পড়ুন-
পূজামণ্ডপে বিশেষ নিরাপত্তা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি
সারাবাংলা/এমএস/একে