আমাদের সমাজে টাকা ধার দেওয়া যেন একধরনের নৈতিক দায়িত্ব— অতি আপন কেউ চাইলে ‘না’ বলা কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক সময় দেখা যায়, যাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মানুষটিই পরে এড়িয়ে চলে, ফোন ধরা বন্ধ করে দেয়, কিংবা দেখা হলে অন্যদিকে তাকিয়ে চলে যায়। এতে কষ্ট হয়, সম্পর্কেও ফাটল ধরে।
অর্থের লেনদেন আসলে শুধু টাকা নয়— বিশ্বাস, প্রত্যাশা ও দায়িত্বের বিষয়। তাই আবেগে নয়, একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। কোন পরিস্থিতিতে টাকা ধার দেবেন, আর কীভাবে ফেরত চাইবেন— জানলে সম্পর্কও টিকে যায়, আর মানসিক শান্তিও অটুট থাকে।
সম্পর্ক— নাকি আর্থিক লেনদেন?
প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন— টাকা ধার দেওয়ার প্রস্তাব এলেই আমরা আবেগতাড়িত হই। কিন্তু প্রশ্ন একটাই— এই ব্যক্তি কি দায়িত্ববান? তার সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন? টাকা ফেরত দেওয়ার মানসিকতা কি আছে? একটু বিবেচনা করলে ভবিষ্যতের অস্বস্তি অনেকটাই কমে।
‘না’ বলাও একধরনের যত্ন
সব অনুরোধ পূরণ করা বাধ্যতামূলক নয়। পরিস্থিতি অনুকূল না হলে বিনয়ের সঙ্গে ‘এ মুহূর্তে পারছি না’— বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে নিজের আর্থিক চাপ কমে, সম্পর্কও অযথা ঝামেলায় পড়ে না।
লিখিত ছোট নোট রাখলে ভুল বোঝাবুঝি কমে
আস্থার জায়গায়ও বাস্তবতার ছোঁয়া দরকার। একটি সহজ চ্যাট, ম্যাসেজ বা নোট থাকলে উভয় পক্ষের দায়িত্ববোধ বাড়ে। ভবিষ্যতে দুপক্ষই মনে রাখে— এটি একটি প্রতিশ্রুতি।
টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করুন— যা হারালেও ক্ষতি সামলানো যায়
ধার দেবেন এমন পরিমাণ, যা ফেরত না এলেও আপনার জীবনে বড় চাপ তৈরি করবে না। এটিই সবচেয়ে কার্যকর আত্মরক্ষা।
সময়সীমা উল্লেখ করুন— আস্থা বাড়ে
‘কবে ফেরত দিতে পারবে?’—এই সাধারণ প্রশ্ন পুরো প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে। স্পষ্ট সময় বললে ভুল বোঝাবুঝি কমে ও দায়িত্ব বাড়ে।
যদি ধার নেওয়া মানুষটি আর যোগাযোগ না রাখে— তাহলে কী করবেন?
রাগ নয়, বাস্তবতা বুঝুন: মানুষ অনেক সময় লজ্জা বা চাপে পড়ে এড়িয়ে যায়। তাই রাগ না করে একটু ধৈর্য ধরুন।
নরম ভাষায় স্মরণ করিয়ে দিন: একটি নম্র ম্যাসেজ পাঠাতে পারেন— ‘তোমার অবস্থা বুঝি, তবু টাকাটা কখন দিতে পারবে জানতে চাইছিলাম।’ এ ধরনের কথা নরমভাবে চাপও তৈরি করে, আবার সম্পর্কও নষ্ট হয় না। কিস্তিতে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব দিন। কারণ, অনেকেই একবারে দিতে না পারলে লজ্জায় চুপ থাকে। আপনি চাইলে ছোট ছোট কিস্তিতে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারেন।
দরকার হলে একজন মধ্যস্থতাকারী যুক্ত করুন
পরিবারের একজন বড় সদস্য বা পরিচিত কাউকে জানালে অনেক সময় সমাধান সহজ হয়। তবে ভাষা অবশ্যই বিনয়ী ও শান্ত রাখুন।
মানসিক শান্তিকে অগ্রাধিকার দিন
বারবার যোগাযোগ করেও লাভ না হলে ছেড়ে দেওয়াও জীবনের পরিপক্ব সিদ্ধান্ত। এটিকে অভিজ্ঞতা ধরে নিন— যে অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে আপনাকে শক্ত করবে।
সবশেষে— টাকার নিয়ন্ত্রণ আপনার, কিন্তু সম্পর্কের মূল্যও কম নয়
জীবনে টাকার গুরুত্ব আছে, কিন্তু শান্তির মূল্য আরও বেশি। তাই আবেগ নয়, বিবেচনার ওপর ভিত্তি করে ধার দিন। স্বচ্ছতা, সম্মান ও দূরদর্শিতা— এই তিনটি মানলেই টাকা ধার দেওয়া কখনোই সম্পর্কের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না।