Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পর্তুগালের লুইস ভাস দি কামোইস ও তার কর্ম


২৬ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৫

পর্তুগালের বিখ্যাত কবি লুইস ভাস দি কামোইস ও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘ওস লুসিয়াদাস’ পশ্চিমা বিশ্বে বহু পূর্বেই খ্যাতি অর্জন করেছে। বর্তমান আধুনিক যুগে লুইস দি কামোইস পর্তুগীজদের কাছে পূজনীয় একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইন্সটিটিউট তৈরি হয়েছে, যেখানে তাঁকে নিয়ে গবেষণা করা হয়।

লুইস ভাস কামোইস এর জন্ম ১৫২৪ সালের ১০ই জুন লিসবনে, মৃত্যু ১৫৭৯ মতান্তরে ১৫৮০ সালে। তাঁর জন্ম লিসবনে হয়েছে কী না, ১৫২৪ সালে কী না তা নিয়ে যেমন দ্বন্দ্ব রয়েছে তেমনি দ্বন্দ্ব রয়েছে মৃত্যু সাল নিয়ে। অনেকের মতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১৫৭৯ সালে তবে ১৫৮০ সাল গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতপক্ষে লেখকের জীবন অনুমান এবং কিংবদন্তি দ্বারা বেষ্টিত। তিনি ছিলেন পর্তুগালের একজন জাতীয় কবি। পর্তুগালে জাতীয় কবির উপাধিতে কোন একক কবিকে ভূষিত করা হয়নি, তবে তাঁকে বিশেষ ভাবে জাতীয় কবির গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং জাতীয় কবি বলে আখ্যায়িত ও গন্য করা হয়। তিনি পর্তুগীজ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম এবং একজন মহান ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি ছিলেন পর্তুগীজ ঐতিহ্যের কবি।

লুইস ভাস দি কামোইসের সমসাময়িকদের সাক্ষ্য অনুসারে তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের একজন ব্যক্তি। লালচে বর্ণ এবং স্বর্ণকেশী চুলের অধিকারী, তাঁর ডান চোখ ছিল অন্ধ, অধিকাংশ শারীরিক ব্যায়ামে ছিলেন দক্ষ এবং স্বভাবে অনেকটাই ক্রোধের অধিকারী। সামান্য মতবিরোধে কলহে জড়িয়ে পরতেন। একজন পারদর্শী সৈনিক হিসেবে তাঁর অনেক মূল্য ছিল। যথেষ্ট সাহস, লড়াই, সন্মানের আকাঙ্খা এবং সেবা করার ইচ্ছে ছিল প্রবল। বন্ধু এবং স্বজন হিসেবে তিনি ছিলেন একজন ভালো সঙ্গী, উদার, প্রফুল্ল এবং বুদ্ধিমান। ভাগ্যের ঘাত প্রতিঘাত এবং দরিদ্রতা তাঁর আত্মাকে কখনই দুর্বল কিংবা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এবং তা বাস্তবায়িত করার লক্ষে লড়াই করতেন। তিনি নিজেকে সর্বদা একজন মানুষ, একজন সৈনিক এবং একজন কবি হিসেবে ভাবতেন এবং তদনুযায়ী তাঁকে গঠন করতে এবং তার যোগ্য করে তুলতে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তিনি বোহেমিয়ান জীবন যাপন করতেন। ঘন ঘন সরাইখানায় যেতেন। বিভিন্ন দাঙ্গা এবং একাধিক উত্তাল প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার আভাসও পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

কবির জীবনীতে বেশ কিছু মহিলাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যাঁদের সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এটা অস্বীকার করার কোনই পথ নেই যে তিনি অবশ্যই ভালোবাসতেন, এমনকি একাধিক মহিলার সাথে তাঁর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। তবে বর্তমানে সেই নামমাত্র পরিচয়গুলোকে অপ্রাসঙ্গিক সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বহুল আলোচিত মহিলার নাম উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, রাজার বোন ইনফান্তা দি মারিয়া। মারিয়া কবির জীবনে চরম সাহসিকতার ভূমিকা রেখেছিলেন। কবির কারাগারকালীন সময়ে তিনি তাঁকে সঙ্গ দিতেন। হতাশ প্রেমের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে ক্যাতারিনা দি আতাইয়ের নাম। তাঁর জীবনে উপস্থিত কথিত নারীদের সম্পর্কে বেশ কিছু পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছিল। কামোইস নিজেই বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁর কবিতা লেখার পিছনে অনুপ্রাণিত হওয়ার জন্য ভূমিকা ছিল বেশ কিছু মিউজিক, নারী ও নানাবিধ অসহনীয় ঘটনায় বিভিন্নভাবে দগ্ধ হওয়ার কষ্ট। তাঁর প্রিয় মহিলাদের নামগুলো কবিতায় আদিমভাবে উপস্থিত করেছিলেন। পাশাপাশি এটাও বলা হয় কবির প্রথম জীবনীতে নাম দ্বারা শনাক্ত করা যায় এমন কোন মহিলার উল্লেখ নেই। পেদ্রো দি মারিজ এবং সেভারিম দি ফারিয়া এরা শুধুমাত্র রানির প্রাসাদে কবির প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে কিছু গুজব ছড়িয়েছিল।

কামোইস ইউরোপীয় রেনেসাঁর চূড়ান্ত পর্যায়ে বসবাস করতেন। তৎকালীন সময় ছিল সংস্কৃতি এবং সমাজের অনেক পরিবর্তন দ্বারা চিহ্নিত। বলা যায় তৎকালীন সময়ে মধ্যযুগের শেষ এবং আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল। সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর চিহ্নিত হয়েছিল। ধ্রুপদী প্রাচিনত্ব থেকে সাংস্কৃতিক রেফারেন্সের পুনঃআবিষ্কার এবং পুনরমূল্যায়নের কারণে এটিকে রেনেসাঁ বলা হয়। সেই সময়ের পরিবর্তনগুলোকে একটি মানবতাবাদী এবং প্রকৃতিবাদী আদর্শের দিকে পরিচালিত করেছিল। মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করেছিল। প্রকৃতির শ্রেষ্ঠত্বের সমতুল্য তদন্তকারী এবং প্রকাশ্য জীবনের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিশেষাধিকার মূলক যুক্তি এবং বিজ্ঞান। সেই সময়ের মধ্যে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হয়েছিল। বেশ কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম এবং পূর্বে অজানা ভৌত সত্তা আবিষ্কৃত হয়েছিল। মহান নেভিগেশন আবিষ্কারের পরে গ্রহের মুখের জ্ঞান পরিবর্তিত হয়েছিল। বৌদ্ধিক জল্পনা-কল্পনা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্পিরিট ক্রমবর্ধমান ছিল। যা পদার্থবিদ্যা, গণিত, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, প্রকৌশল, ফিলোলজি এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে জটিলতা, দক্ষতা এবং নির্ভুলতার অভূতপূর্ব স্তরে পৌছে দিয়ে একটি আশাবাদী ধারণার দিকে পরিচালিত করেছিল।

তাঁর জীবন সম্পর্কে রয়েছে নানাবিধ দ্বন্দ্ব। নিশ্চিত কোন ইতিহাস নেই বললেই চলে, বিদ্যমান যা কিছু সবই আনুমানিক। এটা স্পষ্ট যে তিনি লিসবনে একটি ভদ্র পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তাঁর শৈশব সম্পর্কে যা জানা যায়, তা সবই অনুমেয়। বারো তেরো বছর বয়সে তিনি তাঁর চাচা বেন্তো দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং সুশিক্ষিত হয়েছিলেন। তিনিই তাঁকে পড়াশোনার জন্য কোইম্ব্রাতে পাঠিয়েছিলেন। তথ্য অনুযায়ী জানা যায় তিনি ছিলেন একজন শৃঙ্খলাহীন ছাত্র, কিন্তু জ্ঞানের জন্য ছিল অদম্য আগ্রহ। ইতিহাস, বিশ্ববিদ্যা এবং শাস্ত্রীয় ও আধুনিক সাহিত্যের প্রতি ছিল আকর্ষণ। কিছু পণ্ডিত দাবী করেন তিনি অল্প বয়সে ধ্রুপদী লাইন বরাবর একটি কঠিন শিক্ষা লাভ করতেন, ল্যাটিন ভাষা আয়ত্ত করতেন এবং প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য ও ইতিহাস জানতেন। তবে স্কুলে তাঁর অধ্যায়নের সময় নথিভুক্ত করা নেই। এটা বিশ্বাস করা হয় তিনি কোইম্ব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ও সাহিত্য অধ্যায়ন করেছিলেন, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন তাঁর চাচা, বেন্তো দি কামোইস।

তাঁর পরিবার দরিদ্র ছিল কিন্তু সম্ভ্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি উত্তম প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে পেরেছিলেন এবং দি জোয়াও III এর দরবারে কবি হিসেবে কর্ম শুরু করেন এবং ফলপ্রসু বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি কর্ম জীবন শুরু করেন রাজা D. João III এর দরবারে একজন গিতিকার কবি হিসেবে। ঐতিহ্যের বর্ণনা অনুসারে একটি বোহেমিয়ান এবং অশান্ত জীবন যাপনের পাশাপাশি তিনি একজন সম্ভ্রান্ত মহিলার প্রেমে জড়িয়ে পড়েন।

কথিত আছে একটি হতাশ প্রেমের কারণে তিনি আফ্রিকার নির্বাসনে গিয়েছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। মরক্কোর ভূখণ্ডের সেউটাতে তিনি সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তিনি তাঁর ডান চক্ষু হারিয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ফিরে আসেন পর্তুগালে। ১৫৫২ সালে তিনি একজন নির্দিষ্ট আদালতের কর্মকর্তার সাথে মতবিরধিতা করেছিলেন এবং তাঁকে আহত করেছিলেন। ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এক বছর দণ্ডিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এবং রাজার নিকট হতে ক্ষমা পেয়েছিলেন ।

তিনি ১৫৫৩ সালে পূর্ব দিকে অর্থাৎ ভারতের গোয়ার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। পণ্ডিতদের মতে তিনি সেই সময় থেকে জাতীয়তাবাদী মহাকাব্য “ওস লুসিয়াদাস” লিখতে শুরু করেন। “ওস লুসিয়াদাস” হল কামোইসের মাস্টারপিস। লেখকের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র বই। এটি ছিল একটি মহাকাব্য। ১০ কাব্যিক সিলেবল। এই মহাকাব্যে ভাস্কো দা গামার (১৪৬৯ থেকে ১৫২৪ সাল পর্যন্ত) বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব তুলে ধরেন যা পর্তুগীজ জাতির প্রশংসা করে লিখেছিলেন। তিনি ভারত, ম্যাকাও এবং মোজাম্বিকে বেশ কয়েক বছর বসবাস করেছিলেন এবং সেখানে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সন্মুখিন হয়েছিলেন।

ম্যাকাওতে তিনি মৃত এবং মিসিং সৈনিকদের জন্য প্রধান তত্বাব্ধায়ঙ্কারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি একাধিক যুদ্ধে যোদ্ধা হিসেবে লড়াই করেছিলেন এবং একাধিকবার গেপ্তার হয়েছিলেন। গোয়া থেকে ফেরার পথে তিনি একটি জাহাজ ডুবির শিকার হন এবং তাঁর লিখিত মহাকাব্যের মাস্টারপিসের আসলটি হারিয়ে ফেলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি একটি বাহু দিয়ে সাঁতার কাটতেন এবং অন্য বাহু উঁচু করে তাঁর পাণ্ডুলিপিটি ধরে রেখেছিলেন। সে সময় তাঁর চাইনিজ প্রেমিকা মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে কবি বেশ কয়েকটি শ্লোক উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর সেই প্রেমিকার নামে।

১৫৬৮ সালে তিনি গুরুতর আর্থিক পরিস্থিতির সন্মুখিন হন। সেই সময় তিনি আফ্রিকার মোজাম্বিকে বসবাস করছিলেন এবং আর্থিক ঋণে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এক দুই বছর আর্থিক বিপর্যয়ের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে পর্তুগালে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পর্তুগালে ফিরে আসার মতো আর্থিক অবস্থা না থাকায়, তাঁর বন্ধুরা তাঁর ঋণ পরিশোধ করেছিলেন এবং পর্তুগালে ফিরে যাওয়ার জন্য একটি টিকিট কিনে দিয়েছিলেন।

অনেক উত্থান-পতনের পর তিনি “ওস লুসিয়াদাস” সম্পন্ন করেছিলেন। রাজা দি সেবাস্তিয়াও এর রাজদরবারে তিনি আবৃত্তিতে সেগুলো পরিবেশন করতেন। ১৫৭২ সালে তিনি পর্তুগালে ফিরে আসার পর “ওস লুসিয়াদাস” মহাকাব্য প্রকাশ করেন। প্রকাশিত কাব্যটি তিনি রাজা দি সেবাস্তিয়াও কে উৎসর্গ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি রাজা দি সেবাস্তিয়াও এর কাছ থেকে তাঁর পরিষেবার জন্য আর্থিক সহযোগিতার আবেদন করেন।

রাজা সেবাস্তিয়াও তাঁকে তিন বছরের জন্য পেনশন প্রদান করেন। পেনশনের মূল্য পর্তুগিজ রেইস বছরে পনেরো হাজারের বেশি ছিলোনা। যা একটি বড় মুল্যের পেনশন হিসেবে গন্য করা যায়না। তা যে নগন্য বা নুন্যতম ছিলো না তা যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছিল প্রাসাদের দাসীরা প্রায় দশ হাজার রেইস পেতো, সেই হিসেবে কমও ছিলো না। একজন প্রবীন সৈনিকের জন্য নির্ধারিত পেনশন যথেষ্ট সন্মানজনক বলে তা বিবেচিত হত। তবে দুঃখের বিষয় সেই পেনশন অনিয়মিত ভাবে কবিকে প্রদান করা হয়েছিল। ফলে কবিকে বস্তুগত অসুবিধার সন্মুখিন হতে হয়েছিল। তিনি তাঁর শেষ বছরগুলি ‘সান্তা আনা’ চার্চের কাছাকাছি একটি ঘরে বসবাস করতেন। বলা হয় নিজেকে ঢেকে রাখার জন্য একটি ন্যাকড়া ছাড়া তাঁর আর কিছুই ছিলনা। দরিদ্র সীমার নিচে, দারিদ্রের মধ্যে তিনি বসবাস করেছিলেন।
ফ্রাঞ্চ জ্যোতির্বিজ্ঞানী Guillaume Le Gentil nomer এই দৃষ্টিভঙ্গিটিকে একটি রোম্যান্টিক অতিরঞ্জন বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন লুইস কামোইস পূর্ব (গোয়া) থেকে যা এনেছিলেন এবং সরকারী নথিগুলি প্রমাণ করে যে তাঁর জীবিকার কিছু উপায় ছিল। আলকাসার-কুইবিরের যুদ্ধে পর্তুগিজদের পরাজয়ের পর রাজা দি সেবাস্তিয়াও অদৃশ্য হয়ে যান। ফলে পর্তুগাল স্পেনের কাছে তাঁর স্বাধীনতা হারায়। কবি তখন অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। লে জেন্টিলের মতে, তিনি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হলে তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। জীবনের শেষ দিকে কবি অসুস্থ্য ও নিঃস্ব ছিলেন।

তিনি ১০ জুন ১৫৮০ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সময় তাঁর দাফনের জন্য কোন অর্থ ছিলো না। ফারিয়া ই সোজা তেওফিলো ব্রাগা অনুসারে সান্তা আনা চার্চের একটি অগভীর কবরে বা একই হাসপাতালের দরিদ্রদের কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর মা বেঁচে থাকাকালীন অবস্থায় উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পেনশন পেতে শুরু করেন। টরে দো টোম্বোতে পাওয়া রশিদগুলোর তারিখ অনুসারে কবির মৃত্যুর তারিখ নথিভুক্ত করা হয়। এছাড়াও দি গনসালো কোটিনোর লেখা একটি এপিটাফ সংরক্ষিত আছে। তবে সেখানে তাঁর মৃত্যু ভুলভাবে ১৫৭৯ সাল লেখা হয়েছে।

১৭৫৫ সালের ভুমিকম্পের পরে লিসবনের অধিকাংশ অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সময় পুড়ে গিয়েছিল লুইস ভাস দি কামোইসের নথিপত্র। ১৮৮০ সালে তাঁর কংকাল লিসবনের প্রসিদ্ধ জেরোনিমস মঠের একটি সমাধিতে পুনঃ সমাধিস্থ করা হয়। পরবর্তীতে তাঁর নামে যে কংকাল জমা হয়েছিল তা সম্ভবত অন্য কারোর বলে জানা যায়।

কবির মৃত্যুর অল্প সময়ের পরে তাঁর গীতিকবিতা রিমাস সংগৃহীত হয়। তিনি তিনটি কমিক থিয়েটারের কাজ অসমাপ্ত রেখে যান। জীবিত থাকাকালীন সময় তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন এবং অনেক অবিচার সহ্য করেছিলেন। তৎকালীন সময় তাঁর সৃষ্ট শিল্প যতটুকু মুল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল তদ্রুপ না হয়ে খুব সামান্য আঁকারে তার মুল্যায়ন হয়েছিল। মনোযোগ দেওয়ার জন্য এই বিষয়টিকে তিনি কয়েকবার কতৃপক্ষের নজরে আনার চেষ্টা করেছিলেন। জীবিতকালীন সময়ে তাঁর মুল্যায়ন না হলেও তাঁর মৃত্যুর পরপরই তাঁর কবিতা মূল্যবান এবং উচ্চ নান্দনিক মানের হিসেবে ইউরোপীয় সাহিত্যের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম দ্বারা স্বীকৃত হতে শুরু করে। জনসাধারনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি অর্জন করা এবং বিভিন্ন দেশের কবিদের প্রভাবিত করতে থাকে। কামোইস ছিলেন পর্তুগীজ ভাষার সংস্কারকারী এবং তিনি একটি স্থায়ী ক্যানন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি পর্তুগালের পরিচয়ের অন্যতম শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছেন এবং সমগ্র আন্তর্জাতিক পর্তুগীজ ভাষা-ভাষী সম্প্রদায়ের জন্য একটি রেফারেন্স হয়ে উঠেন।

আজ কবির খ্যাতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁকে পশ্চিমা ঐতিহ্যের অন্যতম মহান সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।। তাঁর রচিত সাহিত্য বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হচ্ছে এবং প্রচুর পরিমানে সমালোচনামূলক অধ্যয়নের বিষয় হয়ে উঠেছে। তিনি কবিতা, মহাকাব্য এবং নাটক রচনা করেছিলেন। এভাবেই তিনি অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন সাহিত্যের একাধিক ক্ষেত্রে এবং পাশাপাশি পেয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয়তা। তাঁর অবশ্যই দুর্দান্ত কাব্যিক ক্ষমতা ছিল। তিনি দুর্দান্ত সৃজনশীলতার সাথে রচনার বিভিন্ন রূপ অন্বেষণ করতে জানতেন। ‘ওস লুসিয়াদাস’ ছাড়াও কবির আরও কিছু রচনাবলি আছে যা সমান ভাবে সমাদৃত হয়েছে সাহিত্য প্রেমীদের কাছে।

পর্যায়ক্রমে তা ছিল এল-কিং সেলুকাস (১৫৪৫ মঞ্চ নাটক), ফিলোডেমাস (১৫৫৬ নৈতিকতা কমেডি), ওস লুসিয়াদাস (১৫৭২ মহান মানবতার মহাকাব্য), হোস্ট (১৫৮৭ (স্বয়ংক্রিয় আঁকারে লেখা কমেডি), রাইমস (১৫৯৫ গীতি কবিতার সংগ্রহ)। ‘ওস লুসিয়াদাস’ লুইস দি কামোইসের একটি দুর্দান্ত মাস্টার পিস। ১৫৭২ সালে প্রকাশিত “ওস লুসিয়াদাস” পর্তুগালের সামুদ্রিক এবং যোদ্ধাদের বীরত্ব উদযাপন করে। অসামান্য বিদেশী বিজয়, অজানা সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে যাত্রা, নতুন ভূমির আবিষ্কার, বিভিন্ন পরিবেশের মানুষ এবং নতুন রীতিনীতির সন্মুখিন হওয়া এবং আবিষ্কার করা নিয়ে লেখা। লেখক পর্তুগীজ ক্লাসিকবাদের অন্তর্গত। তাঁর রচনাগুলো একটি নৃ – কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর কবিতা গুলো ছন্দে রচিত। সনেটের ক্ষেত্রে কবি নতুন পরিমাপ ব্যবহার করেন। তাঁর কবিতায় প্রেমকে আদর্শ করে দেখানো হয়েছে।

লুইস দি কামোইস পর্তুগীজদের কাছে একজন বীর, একজন জাতীয় হিরো। আমাদের দেশের মানুষ পর্তুগীজদের বর্গী বা লুন্ঠনকারী হিসেবেই জানেন। কিন্তু এই বাংলায় পর্তুগীজদের যথেষ্ট অবদানও রয়েছে। তৎকালীন সময়ে পর্তুগীজরা শৌর্যে-বীর্যে ছিলেন এক সাহসী নাবিক জাতি। তাদেরই একজন লুইস দি কামোইস। অনেকেরই এই মহান ব্যাক্তির কথা ও তাঁর কর্ম সমন্ধে জানা নেই। তাই এটি মহান এই ব্যাক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখার প্রচেষ্টা মাত্র।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ নিবন্ধ পর্তুগালের লুইস ভাস দি কামোইস ও তার কর্ম ফৌজিয়া খাতুন রানা সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর