থার্টিফার্স্টে ঢাকার আকাশে ৫০ কোটি টাকার নিষিদ্ধ আনন্দ! কে দায়ী?
৪ জানুয়ারি ২০২০ ১৫:৩৮
ঢাকা: দুই সপ্তাহ ধরে ঘটা করে প্রচারণা চালিয়ে ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার উৎসব ‘থার্টি ফার্স্টে’আতশবাজি ফোটানো-পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়। উন্মুক্ত স্থানে তো বটেই, বাসাবাড়ির ছাদেও এমন কোনো আয়োজনে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু সে নিষেধাজ্ঞায় কোনো কাজ হয়নি। ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ঘড়ির কাটা ১২টা স্পর্শ করতে না করতেই রাজধানী যেন পরিণত হয় আতশবাজির শহরে। একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে টানা ফুটতে ও পুড়তে থাকে আতশবাজি। হাজার হাজার ফানুসে ছেয়ে যায় ঢাকার আকাশ। আতশবাজি বিক্রির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, অন্তত ৫০ কোটি টাকার আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হয়েছে থার্টি ফার্স্ট নাইটকে সামনে রেখে।
নববর্ষের ফানুসের আগুনে জার্মানির চিড়িখানায় বেশ কিছু প্রাণীর মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও স্থান পেয়েছে। তবে বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সে রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানেও আতশবাজি আর ফানুসের কারণে আগুন ধরে গিয়েছিল।
সুত্রাপুরের সাব্বির আহমেদের ছেলে আরাফাত ইসলামের গায়ে ফানুসের আগুন পড়ে। এতে আহত হয় সে। ওয়ারীর লিটন আতশবাজির ছিটা পড়ে আহত হন। উত্তরার মিরাজুল ইসলাম আতশবাজির আগুনে পুড়ে আহত হন। এসব ঘটনার পর প্রত্যেকই আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো বন্ধে পুলিশকে আরো বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালনে উদ্যোগী হতে বলেন।
দেশে বিস্ফোরক আমদানি, এর ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ ও মজুদ নিয়ে নজরদারি প্রতিষ্ঠান বিস্ফোরক পরিদপ্তরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে এর প্রধান পরিদর্শক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ সারাবাংলাকে বলেন, জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোর জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আতশবাজি আমদানির জন্য অনুমতি দেওয়া আছে। এর বাইরে দেশে আতশবাজি আমদানি, ব্যবহার ও মজুদ সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপরেও যারা আতশবাজি বিক্রি করেন তারা চোরাইপথে অথবা অবৈধভাবে আনছেন।
বিষয়টিতে তাদের নিয়মিত তদারকি রয়েছে জানিয়ে এই প্রধান পরিদর্শক বলেন, কোথাও কোনো দোকানে আতশবাজি পাওয়া যায় না বলেই জানি।
কোথায় এসব বিক্রি হচ্ছে তা জানতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের আরো বেশি সজাগ থাকতে বলেন মঞ্জুরুল হাফিজ।
গত ৩১ ডিসেম্বর থার্টিফার্স্ট নাইট রাত ১২ টা থেকে ১টা পর্ন্ত ঢাকার আকাশে অসংখ্য আতশবাজি ফুটতে দেখার পর অবৈধভাবে আতশবাজি বিক্রি হওয়া নিয়ে কোনও সন্দেহ যে নেই তা এক বাক্যে স্বীকার করে নেন এই দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা।
নিষেধাঙ্গা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক আতশবাজি ও ফানুস কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে জানতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করা হয়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার এলাকায় বেশ কিছু দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর দিন ও রাতে ভ্যানে করে আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করা হয়েছে।
তাদের দাবি চকবাজারের কোনো দোকানে আতশবাজি বিক্রি হয় না। তবে দুএকটি দোকানে ফানুস বিক্রি হয়।
চকবাজারের একটি দোকান সুরমা এন্টারপ্রাইজ। এর মালিক সাদাত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, আতশবাজি ও ফানুস সারাবছর বিক্রি হয় না। পুরান ঢাকার অন্যতম সাকরাইন উৎসব ও থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে এগুলো বিক্রি হয়। এছাড়া সারাবছর টুকটাক বিক্রি চলে। তবে যে কারণেই হোক নিষিদ্ধ এই পণ্য অনেকটা চুপিসারেই বিক্রি হয়।
আতশবাজির কোনো নির্দিষ্ট দোকান না থাকলেও শাখারীবাজার এলাকায় যখন তখন এই নিষিদ্ধ পণ্য মেলে বলেই জানান সাদাত হোসেন।
চকবাজারে মোমবাতি ও আগরবাতি বিক্রি করেন নুর ইসলাম। তিনি বলেন, সবার ধারণা মোমবাতি ও আগরবাতির দোকানগুলোতে আতশবাজি ও ফানুস পাওয়া যায়। একারনে প্রায়ই ক্রেতারা আমাদের দোকানে আসে। তবে এ ধারণা সঠিক নয়। ক্রেতারা আসলে আমরা শাখারী বাজারে পাঠিয়ে দেই।
বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় শাখারীবাজার লেনে গিয়ে আতশবাজির খোঁজ নিতেই নীল ট্রেডার্সের মালিক নীলাদ্রি দেবনাথ নীল বলেন, কোনো নিষিদ্ধ জিনিস দোকানে পাওয়া যায় না।
তবে তিনি পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘১৭ নম্বর দোকান থেকে শুরু করে ১৮০ নম্বর দোকান পর্ন্ত হাঁটতে থাকেন পেয়ে যাবেন আতশবাজি।’
সে অনুযায়ী এই প্রতিবেদক পথে হাঁটতে শুরু করতেই দুই কিশোর জানতে চাইল, ‘স্যার আতশবাজি লাগবে নাকি!’ আগ্রহ দেখাতেই জানালো পেন্টা, কোবরা আর স্টারশাইন সবই আছে। দামও আগের চেয়ে কমে গেছে।
‘লইয়া যান স্যার, কয়েকদিন পর দাম আবারও বাড়বে। সাকরাইন আসলে খুঁজেও পাবেন না,’ এভাবেই ক্রেতা ধরতে চেষ্টা করে দুই কিশোর।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শাখারীবাজার লেনের বাসাগুলোর গেটে কিংবা গলির মাথায় আতশবাজি বিক্রির জন্য দাড়িয়ে থাকে বিক্রেতারা। এদের মধ্যে কিশোর বয়সী ছেলেই বেশি। রয়েছে বড়দেরও অংশগ্রহণ।
এরা অর্ডার পেলে অগ্রিম টাকা নিয়ে ভেতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর তারা আতশবাজি নিয়ে হাজির হয়। কেউ কেউ ফেরে না, টাকা হাতে পেয়ে চম্পট দেয়। ফলে অনেকের টাকা খোয়া যায় বলেও জানা গেলো সেখান থেকে।
চকবাজার, শাখারীবাজার ছাড়াও আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হয় সুত্রাপুর বাজারেও। এখানে আলমগীর স্টোর নামের একটি দোকানে আতশবাজি মেলে এমন তথ্যে এই প্রতিবেদন সরাসরি সেখানে হাজির হন। সেখানে গিয়ে আতশবাজি চাইতেই জবাব আসে, ‘আছে, কোনটা কত পিস লাগবে? দাম জানতে চাইলে কমান্ডো ফয়েলস ৫৫০ টাকা আর ফোয়ারা ৩৫০ টাকা বলে জানান দোকানি। এই আলমগীর স্টোর থেকে গত এক সপ্তাহে অন্তত ৫০ লাখ টাকার আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
চকবাজার, শাখারীবাজার থেকেই জানা গেলো এবছর অনলাইনেও বিক্রি হয়েছে আতশবাজি, ফানুস। মনস্টার, ফায়ার ওয়ার্কস, ড্রিম নাইট, আতশবাজি ও ফানুস এসব নামে ফেসবুক পেজ ওপেন করে এসব নিষিদ্ধপণ্য বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এসব পেজের বিক্রেতারা কত টাকার আতশবাজি বিক্রি হলো সে সম্পর্কে তথ্য দিতে রাজি হননি।
ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ‘আতশবাজি ও ফানুস’ নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মালিক সিদ্দিকী রহমানের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, শুধুমাত্র ৩১ ডিসেম্বর অনলাইনের মাধ্যমে আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি করেছেন ৪০ লাখ টাকার। এক সপ্তাহে বিক্রি করেছেন অন্তত ৩ কোটি টাকা। ঢাকার বাইরে থেকেও অর্ডার ছিল বলে জানান এই বিক্রেতা।
প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর থার্টিফার্স্ট নাইট ও ১৪ জানুয়ারি সাকরাইন উপলক্ষে আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হয় জানিয়ে সিদ্দিকী রহমান জানান, আসছে সাকরাইন উৎসবে থার্টি ফাস্টের চেয়ে অন্তত ১০ গুন বেশি আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হবে বলে তাদের প্রত্যাশা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমদানি নিষিদ্ধ থাকলেও বিপুল পরিমাণ চাহিদা থাকায় বর্ডার এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয় আতশবাজি ও ফানুস। আর এজন্য বিজিবি, পুলিশসহ প্রশাসনের অনেককে ম্যানেজ করতে হয় বলেও জানান তিনি।
সূত্র মতে, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেই সব ধরণের আতশবাজি ও ফানুস অবৈধ পথে আনা হয়। নাম মাত্র মূল্যে এসব আতশবাজি ও ফানুস নিয়ে আসার পর তা উচ্চ দামে বিক্রি হয়। উৎসবকে কেন্দ্র করে দাম দ্বিগুন তিনগুনও হয়।
ঘুরে ঘুরে পাওয়া তথ্য মতে, গত ২৩ ডিসেম্বর শাখারীবাজারে কমান্ডো ব্র্যান্ডের একটি আতশবাজি বিক্রি হয়েছে ৫৫০ টাকা। ৩১ ডিসেম্বর সেটি বিক্রি হয়েছে ৯০০ টাকায়। হাইড্রো ফয়েলস ২৭ ডিসেম্বর বিক্রি হয়েছে ৪৪০ টাকা। অথচ ৩১ ডিসেম্বর সেগুলোই বিক্রি হয়েছে ৮০০ টাকায়। ৩১ ডিসেম্বর ফোয়ারা ব্রান্ডের আতশবাজি ১২০০ টাকায় বিক্রি হয় বলেও দাবি করেছেন কোনও কোনও বিক্রেতা।
কারা কেনেন এসব আতশবাজি? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে দেখা মেলে পুরান ঢাকার তরুণ আখলাকুজ্জামান সপ্ত’র সঙ্গে। তিনি জানালেন, প্রতিবছর থার্টিফার্স্ট নাইটে ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখেন স্রেফ আতশবাজির জন্য। সাকরাইনেও তার বরাদ্দ ১০ হাজার টাকা। সপ্ত সারাবাংলাকে বলেন, তিনি একা নন, পুরান ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদে থার্টিফার্স্ট নাইটে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার আতশবাজি পোড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় অন্তত ৩০ হাজার বাড়ি রয়েছে। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ছাদেই বাজি ফোটানো হয়। তাতেই হিসাব করে নেওয়া যায় হ্যাপি নিউ ইয়ার আর সাকরাইনে কত টাকার আতশবাজি ফোটানো হয়।
রায় সাহেব বাজার এলাকার যুবক জিল্লুর রহমান বলেন, সাকরাইন ও থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে কোটি কোটি টাকার আতশবাজি ও ফানুস বিক্রি হয় পুরান ঢাকায়।
তবে অবৈধ পথে আসে এবং বিক্রি হয় বলে এই বিপুল অংকের ব্যবসার কোনো অংশই সরকার পায় না।
জিল্লুর বলেন, সবই অবৈধ পথে আসে এবং চুপিসারেই বিক্রি হয়, বলেন তিনি।
ভারত থেকে বেনাপোল সীমান্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক আতশবাজি ও ফানুস ঢাকায় আসে বলে জানান তিনি।
থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকার আকাশে এত নিষিদ্ধ আতশবাজি ফুটলো সে সম্পর্কে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি মনে করছে জানতে চাইলে, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃঞ্চপদ রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘আতশবাজি কারা কিভাবে আনছেন এবং বিক্রি করছেন সে বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। জড়িত ব্যক্তিদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/এমএম