ঢাকা: রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা খাতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘বিশেষ মর্যাদা’ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
রোববার (১ জুন) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নিকট এই দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম, স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এম এ কাউসার, স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মাহবুবা সুলতানা, শামসুন্নাহার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল আজিম, উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ প্রমুখ।
৮৩টি বিভাগের সই করা এই স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার পাশাপশি এই জনপদের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অগ্রগতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বুদ্ধিভিত্তিক দিক-নির্দেশনা, রাজপথের নেতৃত্ব এবং সম্মুখসমরে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অনন্যসাধারণ ভূমিকা সুবিদিত। নব্বই-এর সফল স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে চালকের আসনে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। তারই ধারাবাহিকতায় ফ্যাসিবাদী সরকারের জুলুম-নির্যাতন ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সূচনা এবং স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত করে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নবযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরাই নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছেন। ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশের সরকার পরিচালনায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাক্তনীরা।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিধারা অব্যাহত রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শতাব্দী জুড়ে মানবসম্পদ তৈরির প্রক্রিয়া চলমান রেখেছে। দেশের সরকারি, বেসরকারি, শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রকৌশল এবং বহুজাতিক খাতের সকল পর্যায়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকগণ ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখছেন। দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুনামের সঙ্গে তারা কর্তব্য পালন করছেন। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে দেশের প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষাদানের দরজা সমাজের সকল আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার মানুষের জন্য উন্মুক্ত রেখেছে। দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য উচ্চমানের শিক্ষা প্রদানের এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘অবিরত চর্চার মাধ্যমে বিদ্যমান জ্ঞানের বিকাশ, নতুন জ্ঞান সৃজন এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে আলোকিত মানব সম্পদ তৈরির পাশাপাশি জাতি বিনির্মাণে সকল ক্ষেত্রে অবদান রাখার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা ক্ষেত্রে উপেক্ষার শিকার হয়ে চলেছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের পদচারণা থাকলেও মেধার লালন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বরাবরই অনীহা পরিলক্ষিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ ও অবকাঠামো তৈরি করা কখনই সম্ভবপর হয়নি। এতদসত্ত্বেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবে শিক্ষকদের, বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করা যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকগণের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তবে আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তির এই জায়গাটি আজ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। অপ্রতুল আর্থিক সুবিধা এবং গবেষণার যথোপযুক্ত পরিবেশ ও ব্যবস্থা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকগণের অনেকে বিদেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বিবেচনায় না আনলেও দেশের প্রধান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে তুলনা করলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধার অপর্যাপ্ততার বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়। এই আর্থিক এবং অন্যান্য বাস্তবতা বিবেচনা করে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মেধাবী শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে বাধ্য হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। আর্থিক ও পেশাগত অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এবং সম্মানের কথা বিবেচনা করে বিকল্প পেশা গ্রহণের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালটি আজ নিজের মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। এটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে বলে আমরা মনে করি।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা ও নানাবিধ সমর্থন-সহযোগিতা প্রদান করার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার পাশাপাশি জাতি গঠনে সর্বোচ্চ অবদান রাখার পথ সুগম করে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং ভারতের আইআইটি।
এ বিষয়ে সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে যত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হয়েছে সব আন্দোলনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান ছিলো অগ্রগামী। শুধু তাই নয় শিক্ষা ও গবেষণায়ও ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই কোন বিশেষ মর্যাদা। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ মর্যাদা দেয়ার নজির রয়েছে। আমরা চাই, সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করবে।’
সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা যুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এবং সর্বশেষ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।’ ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তিনি মাননীয় উপাচার্যকে অনুরোধ জানান।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটা দেশে একটি করে আইকনিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমাদের দেশে তেমন কোন বিশ্বিবদ্যালয় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ নামক একটি দেশ সৃষ্টি করেছে তবে তার কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়নি। এখনই সময় এটা দেওয়ার। যাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার একাডেমিক ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যাবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে।’
উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন এবং সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান। তিনি এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানান।