Tuesday 03 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘জুলাই গণহত্যার বিচার অতীতের প্রতিশোধ নয়, ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১ জুন ২০২৫ ১৯:০৩ | আপডেট: ১ জুন ২০২৫ ২০:২৩

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ-সহিংসতা বাংলাদেশকে ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ‍্যভূমিতে পরিণত করেছিল।

রোববার (১ জুন) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের আগে সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

বিজ্ঞাপন

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘আমরা এই বিচার শুরু করেছি জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। যেখানে নিরস্ত্র, নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবক, নারী ও শিশু-যারা একটি ন্যায়ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কু-প্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস-ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘২৪-এর এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ও সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ, নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংতার শিকার হন। তাদের নির্দেশে-নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের দিয়ে সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেফতার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসায় বাধা, মৃত-জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী সব অপরাধ।’

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, “২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত। যা সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন, মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আসামিদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেওয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূলের উদ্দেশ্যে সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওই সব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়।”

তাজুল ইসলাম বলেন, ‘উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়- এটি ছিল একটি Coordinated Extermination Plan, যা ছিল Widespread এবং Systematic। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, অন্যান্য বাহিনী ও সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতারাসহ তাদের অধীনস্থ সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে।’

এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয়, বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অফ দি আইসিসি’ ও বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য। ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয় প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিক্টিমদের সাক্ষ্য। অপরাধ সংগঠনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ। ড্রোন ও সিসিটিভি ফুটেজ। আসামিদের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস। ডিজিটাল এভিডেন্সের ফরেন্সিক রিপোর্ট। আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য, ছবি ও ভিডিও। জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রস্তুত করা রিপোর্ট। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি।’

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, ‘এই বিচার অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা। আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে- সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের উর্ধ্বে থাকবে না।’

তিনি বলেন, ‘বিচার শুরুর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সেসব ভুক্তভোগীদের, যারা আর কোনোদিন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসবে না। স্মরণ করছি তাদেরও যারা এই আন্দোলনে চোখ, হাত-পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ হারিয়েছেন। স্মরণ করছি সেসব অকুতোভয় মানুষদের, যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণে এই রাষ্ট্র অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোকজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে- যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে। আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ, প্রমাণ নির্ভর ও ন্যায়ভিত্তিক। আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক, বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।’

সারাবাংলা/আরএম/পিটিএম

জুলাই গণহত্যা টপ নিউজ প্রতিজ্ঞা প্রতিশোধ নয় বিচার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর