গুলশান ট্রাজেডি: ‘ক্লডিয়া ছিলেন বার্নের অকৃত্রিম বন্ধু’
৩০ জুন ২০১৮ ১৮:১৯
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ক্লডিয়া মারিয়া ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম একজন বন্ধু। এ দেশের মানুষকে স্বার্থহীণভাবে ভালোবেসেছিলেন তিনি। বিশেষ করে দেশের বার্ন রোগীদের জন্য তিনি যা করেছেন মানুষ হিসেবে তা কোনও দিনও ভোলার নয়।
রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান ট্রজেডিতে নিহত ইতালির নাগরিক ক্লডিয়া মারিয়া সম্পর্কে এ কথাগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সংশ্লিষ্টদের।
২০১৬ সালের ১ জুলাই সংঘটিত ওই জঙ্গি হামলায় অন্য বিদেশিদের সঙ্গে নিহত হন ৯ ইতালীয়। ক্লডিয়া মারিয়া তাদেরই একজন।
বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সংশ্লিষ্টরা জানালেন, ২০১৬ সালের আগে প্রত্যেক দুই বছর পরপর ‘ইন্টারপ্ল্যাস্ট’-ইতালি নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন বাংলাদেশে আসতো। ইউরোপের বিখ্যাত সব প্লাস্টিক সার্জনদের নিয়ে গঠিত ইন্টারপ্ল্যাস্ট বাংলাদেশে এসে ঢামেক’র বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ঠোট কাটা-তালু কাটা রোগীদের বিনামূল্যে সার্জারি করতো। ওই চিকিৎসক দলের যাবতীয় কাজ করতেন ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসে ব্যবসা করা ক্লডিয়া মারিয়া।
চিকিৎসকরা বলেন, এই চিকিৎসক দলকে নিজের বাসায় রেখে তাদের দেখভাল করা, কতো যন্ত্রপাতি সবকিছু বুঝে নেওয়া-সব করতেন ক্লাউডিয়া। এতো সুন্দর করে সব করতেন, ইতালির একটা দল আসবে কিন্তু আমাদের নিজেদের কিছু দেখতে হত না। সব করতেন ক্লডিয়া। আমরাও নির্ভার থাকতাম- ক্লোডিয়া আছে, আমাদের আর কোনও চিন্তা নেই। আমরা শুধু অস্ত্রোপচারের শিডিউল করতাম, রোগীদের দেখাতাম- ক্লডিয়া- ‘শি টাচেস আওয়ার হার্ট’।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের সঙ্গে ক্লডিয়া মারিয়া।
তারা বলেন, জন্মগত ঠোঁট কাটা-তালু কাটা এসব রোগীদের চিকিৎসায় ‘ক্লেফট’ ক্যাম্পের মাধ্যমেই বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ইতালির নাগরিক ক্লডিয়া মারিয়া। তবে যোগাযোগটা পরে আরও গভীর হয় ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে আগুন সহিংসতার সময়ে। সে সময় বার্ন ইউনিটে ক্লডিয়া চিকিৎসকদের পাশে থেকেছেন, অগ্নিদগ্ধদের পাশে দাড়িয়েছেন ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা নিয়ে।
ক্লডিয়া মারা যাবার পর এই দলের আসাটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে জানিয়ে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ক্লডিয়ার সঙ্গে পরিচয় এই বার্ণেই। খুব ভালো সর্ম্পক ছিল আমাদের। বাংলাদেশের কোথায় কোন দরিদ্র মানুষ রয়েছে যার চিকিৎসা হচ্ছে না, অথবা গর্ভবতী কোনও নারীর অবস্থা আশঙ্কাজনক-সে যখনি জেনেছে তখনি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। অসুস্থ মানুষটিকে কী করে সেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ঢাকায় আনা যায়, কী করে তার চিকিৎসা করা যায়-সেসব নিয়ে কথা বলেছেন। কেবল কথা বলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিয়েছেন তিনি।
ডা. সামন্ত লাল সেন আরো বলেন, বিদেশী টিমগুলো যখন আসতো তখন তারা হোটেলে থাকতেন। একসময় দেখা গেল, তাতে বিপুল টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। তখন ক্লডিয়া ১২ থেকে ১৪ জনের মতো টিমটাকে তার বাসায় রাখতেন, তাতে করে হোটেলের খরচটা বেঁচে যেত। আর বেঁচে যাওয়া সেই টাকা তারা দেশে ফিরে যাবার সময় বার্নের অসহায় রোগীদের দিয়ে যেতেন। এভাবেই পুরো টিমের সঙ্গে থেকে ক্লডিয়া এদেশের মানুষের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ হয়ে উঠেছিলেন।
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আনপ্যারালাল’ একজন মেয়ে ছিলেন ক্লডিয়া। বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে ভালোবাসা আমরা দেখেছি-তা এখনও চোখ বন্ধ করলে অনুভব করি। তার সে অবদান আমাদের অনুতপ্ত করে, অপরাধী করে। যে দেশের মানুষের জন্য তিনি এতো করেছেন, যে দেশের মানুষকে এতো ভালোবেসেছেন-সেই দেশেই তাকে মেরে ফেলা হলো। এটা খুব দুঃখজনক-এ ক্ষতি আমাদের পোষাবার নয়, আমি কোনোদিন তাকে ভুলবো না।
কখন ক্লডিয়ার মৃত্যুর খবর শুনলেন এ প্রশ্নে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, হামলাতে ইতালির নাগরিক নিহত হয়েছেন সেটাতো পরদিন থেকেই শুনেছি। কিন্তু আমার মাথাতেই আসেনি ক্লডিয়ার কথা। হয়তো প্রিয়মানুষের মৃত্যুর কথা অবচেতন মনও চিন্তা করতে পারছিল না। পরে তার কথা শুনে ফোন করি, কিন্তু সেই ফোন আর কেউ রিসিভ করেনি। তারপরই আরেকজন ইতালিয়ান আমাকে জানালেন, ‘দিস ইজ দ্যাট ক্লডিয়া’। এই হাসপাতালটা ছিল ক্লডিয়ার আবেগের একটি নাম, তার ভালোবাসার জায়গা ছিল এই বার্ন ইউনিট।
কেবল আমি না, বার্নের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে সে সমান দরদ নিয়ে কথা বলতো। ডা. সামন্ত লাল সেনের কথা শেষ না হতেই পাশ থেকে ‘ক্লডিয়া ম্যাম’ ছিলেন আমাদের মতো গরীবের বন্ধু- বলে উঠলেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইব্রাহীম হোসেন। তিনি বলেন, যারা অসহায় ছিল-তাদের বন্ধু ছিলেন ক্লডিয়া ম্যাম। তার কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে আমার ছেলের লেখাপড়া চলতো।
দেখা হলেই কপালে হাত তুলে বলতেন-‘সালামালাইকা ইব্রাহীম বাই’- তিনি এতো ভালো মানুষ ছিলেন। এই বার্নে একজন বিদেশী আমাদের মতো করে হাসপাতালের রোগীদের দেখতেন, কপালে হাত রাখতেন, হাত ধরে কথা বলতেন-সেই মানুষটাকে এমন করে মাইরা ফেলাইলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে ইব্রাহীম হোসেনের।
স্বাস্থ্য বিষয়ক গণমাধ্যমকর্মী জান্নাতুল বাকেয়া কেকার সঙ্গে ছিল ক্লডিয়ার ছিল খুব ভালো পরিচয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালে আগুণ সহিংসতার পর বার্ন ইউনিটে কাজ করার সুবাদে কেকার সঙ্গে সর্ম্পক আর দৃঢ় হয় ক্লডিয়ার। তাইতো ক্লডিয়ার কথা এখনও স্মরণ করেন কেকা। তিনি বলেন, বার্ন ইউনিটে যখন একের পর এক অগ্নিদগ্ধ মানুষ আসছিলেন তখন ক্লডিয়া এখানে রাত দিন ছিলেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। তখন তার সঙ্গে আমার সর্ম্পক খুব বেশি দৃঢ় হয়। তিনি আমাকে ‘সফট হার্ট’ এবং ‘গুড সোল’ বলে সবসময় সবার কাছে বলতেন, নিজেও ডাকতেন এভাবেই।
বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হোসাইন ইমাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইন্টার প্ল্যাস্ট’- ইতালির চিকিৎসক দলের সবকিছু মেইনটেইন করতেন ক্লডিয়া। তারা ঠিকমতো আসছেন কি-না, কোথায় থাকবেন তারা, অপারেশন ঠিকমতো হলো কি-না-সবকিছু দেখতো ক্লডিয়া। চিকিৎসক দলটাও খুব নির্ভর করতো তাদের ‘দেশি’র ওপর। আমাদের কোঅর্ডিনেশন পয়েন্ট ছিল সে। এমনকী অস্ত্রোপচার কক্ষেও ঢুকতেন তিনি। জিজ্ঞেস করতেন সব ঠিক রয়েছে কি-না। আবার অস্ত্রোপচারের পর পোস্ট অপারেটিভে ঢুকেও রোগীদের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি কিন্তু ‘ডাক্তার’ ছিলেন না, কিন্তু তার যে ‘ফিলিং’-সেটা কোনও অংশেই কারও চেয়ে কম ছিল না।
একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সর্ম্পক ছিল আমাদের সঙ্গে ক্লডিয়ার। তিনি মারা যাবার পর কিন্তু ইন্টারপ্ল্যাস্ট টিম আর আসেনি। এতো শকড হয়েছেন তারা এ ঘটনায়, প্রতিবছর তারা বাংলাদেশে এসে বিণামূল্যে এই যে অপারেশন করে দিয়ে যেতেন সেটাও কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আমরা ক্লডিয়াকে হারিয়ে আসলেই মনে করি, খুব কাছের একজন বন্ধুকে আমরা হারিয়েছি। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আমাদের, বলেন ডা. হোসাইন ইমাম।
সারাবাংলা/জেএ/এমএস
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook