সিলেট: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর এলাকা থেকে শত শত কোটি টাকার পাথর লুটের ঘটনায় অবশেষে টনক নড়েছে প্রশাসনের। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে চলা এই লুটপাটের প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। এর প্রেক্ষিতে, বুধবার রাতে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকের পর যৌথ বাহিনী অভিযানে নামে।
অভিযানে এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার ঘনফুট লুট হওয়া পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। লুটের অভিযোগে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে এবং হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও করা হয়েছে।
চলতি বছর ও ২০২২ সালের বন্যায় পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে ধলাই নদীর উৎসমুখে প্রচুর পাথর জমা হয়। কিন্তু একদল অসাধু চক্র প্রকাশ্যে নৌকা দিয়ে সেই সব পাথর লুট করে নিয়ে যায়। শত শত নৌকা ব্যবহার করে দিনরাত এই পাথর পরিবহন করা হয়।
পাথর উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে অবৈধভাবে পাথর তোলা হয়। এর পেছনে রয়েছেন মূলত পাথর ব্যবসায়ীরা, যাদের অনেকেই রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত। এছাড়া, নদীর তীর থেকে বালু ও মাটিও অবৈধভাবে উত্তোলন করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই লুটপাট বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশাসনের এমন নীরব ভূমিকার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠলে টনক নড়ে তাদের। এর পরেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই ঘটনায় তদন্ত শুরু করে।
বুধবার রাত সোয়া সাতটা থেকে নয়টা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সিলেট জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এই সভায় স্থানীয় প্রশাসন, সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের সিদ্ধান্তের পর গভীর রাত থেকেই যৌথ বাহিনী অভিযানে নামে।
জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, বুধবার মধ্যরাত থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৫ হাজার ঘনফুট লুট হওয়া পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা এই পাথরগুলো সাদা পাথরে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে।
বৈঠকে লুট হওয়া পাথর উদ্ধার করে আগের অবস্থানে নেওয়া, পাথর চুরি, লুটের সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং গোয়াইনঘাট ও কোম্পানিগঞ্জে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে যৌথ বাহিনীর সার্বক্ষনিক দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই সিদ্ধান্তের পর রাতেই যৌথ বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে নামে। তারা ভোলাগঞ্জের বিভিন্ন পাথর ভাঙার মেশিন, সড়ক ও বাসা-বাড়ির আশপাশ থেকে লুট করা পাথর উদ্ধার করে সাদাপাথরে ফিরিয়ে আনে। এভাবে সাদা পাথরের খালি জায়গাগুলো আবার আগের মতো পাথর দিয়ে ভরে তোলা হচ্ছে।
প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, বুধবার গভীর রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৩৫ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জানান, “জেলা প্রশাসন পাথর লুটপাট ঠেকাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। এরপরও পাথর লুটপাট হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠক করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর কার্যকারিতা শুরু হয়ে গেছে। দ্রুতই এর ফল দেখা যাবে। যে কোনো মূল্যে পাথরখেকো চক্রের অপতৎপরতা ঠেকানো হবে। “
আওয়ামী লীগের শাসনামল থেকে সিলেটের ছয়টি কোয়ারি থেকে অবাধে পাথর লুটপাট করা হচ্ছে। চব্বিশের পট পরিবর্তনের পর ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্র থেকে প্রকাশ্যে লুটপাট শুরু হয়। দেশের সর্ববৃহৎ “রেলওয়ের সংরক্ষিত বাঙ্কার” এলাকা থেকে অফুরন্ত পাথর লুট করা হয়েছে। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে।
পাথর লুট জড়িত বিএনপি নেতা গ্রেফতার:
এদিকে পাথর লুটের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর আলমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান।
গ্রেফতার ইউপি চেয়ারম্যান হলেন পূর্ব ইসলামপুর ২ নম্বর ইউপির চেয়ারম্যান মো. আলমগীর আলম। তিনি জেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক।
কয়েক শ’ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে: দুদক
লুটপাটে মরুভূমিতে পরিনত সাদাপাথরের “রাস্ট্রিয় সম্পদ” রক্ষায় অবশেষে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার (১৩ আগস্ট) দুপুরে দুদক সিলেট কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফী মোহাম্মদ নাজমূস সাদাতের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি তদন্তদল সরেজমিন পরিদর্শন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের রাফী মোহাম্মদ নাজমূস সাদাত বলেন, ‘এটা মূলত স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্ব। ‘এখানে কয়েকশ’ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করা হয়েছে। পর্যটকরা সাদাপাথরে এসে হতাশ হচ্ছেন।
কারা এই লুটের সঙ্গে জড়িত এমন প্রশ্নে দুদক সিলেট কার্যালয়ের উপ-পরিচালক বলেন, এখানকার প্রভাবশালী ব্যক্তি, স্থানীয় লোকজন, আরও অনেক উচ্চস্তরের ব্যবসায়ীরা জড়িত বলে শুনতে পাচ্ছি। আমরা এসব তথ্য নিয়ে আরও কাজ করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আজকের পরিদর্শনের প্রতিবেদন প্রধান কার্যালয়ে পাঠাব। তারপর তাদের নির্দেশনায় পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যারা এই লুটের সঙ্গে যুক্ত তাদের সবাইকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এরপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
হাইকোর্টে রিট আবেদন:
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর লুটের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে।
রিটে আবেদন করা হয়েছে যেন ওই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেয় এবং সেখানে যেন অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মীর একেএম নূরুন নবী এ রিট করেন।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ টিম সিলেটে?
সিলেটের সাদাপাথরসহ বাকি ছয়টি কোয়ারীতে গত কয়েক বছর ধরে সীমাহীন লুটপাটের বিষয় তলিয়ে দেখতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের একটি টিম সিলেটে কাজ শুরু করেছেন বলে একটি অসমর্থিত সূত্র থেকে জানা গেছে। এই সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে না জানিয়ে এই টিম কাজ করছে। তবে এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত কোনো খবর পাওয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, সাদাপাথর প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি পর্যটনকেন্দ্র। ২০১৭ সালে পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথরমহালের ধলাই নদের উৎসমুখে পাঁচ একর জায়গাজুড়ে জমা হয় পাথর। ঢলের তোড়ে সেখানে সর্বশেষ ১৯৯০ সালে একবার পাথর জমা হয়েছিল। সেসব পাথরকে ‘ধলাসোনা’ বলে অভিহিত করা হয়। তবে পাহাড়ি ঢলের পর লুটপাটে সেসব পাথর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ২৭ বছরের মাথায় ফের পাথর জমা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের পাহারায় সংরক্ষিত হয়।