ঢাকা: ‘তুমি এমন স্বার্থপর কেন আম্মু? আমি এখন বাসায় যেতে পারব না। আমার সামনে চার-চারটা লাশ। আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি। মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা করো না।’ মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে কথোপকথনে এভাবেই বলেছিলেন শহিদ সাজ্জাদ হোসেন সজল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আন্দোলনে গিয়ে ‘অঙ্গার’ হয়ে ফেরা ছেলের পুরো বর্ণনা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন সজলের মা শাহীনা বেগম।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য ছিল রোববার (১৭ আগস্ট)। আর এ মামলার ৯ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শাহীনা। তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেল। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাকে জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
জবানবন্দিতে শাহীনা বলেন, “২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেয় আমার ছেলে। আমি হাসপাতালে যাই। সেদিন সকাল থেকেই হাসপাতালে অনবরত গুলিবিদ্ধ রোগী আসছিল। তখন বারবার ছেলেকে ফোন করে বলি- ‘বাবা তুমি বাসায় ফিরে আসো। হাসপাতালে অনেক গুলিবিদ্ধ লোক আসছে। তোমার আন্দোলনে থাকার দরকার নেই।’ তখন ছেলে আমাকে বলে, ‘তুমি এমন স্বার্থপর কেন আম্মু? আমি এখন বাসায় যেতে পারবো না। আমার সামনে চার-চারটা লাশ। আমি একজন আহতকে ধরে বসে আছি। ঠিক বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে দুটি মরদেহ (ডেড বডি) আসে। অনেক আহতকেও আনা হয়। এসব দেখে ছেলেকে আবারও ফোন করি। জবাবে ছেলে বলে, ‘আমাকে তুমি কিভাবে ফেরত আসতে বলো।’ আমি তখন বলি- ‘তুমি আমার একমাত্র ছেলে। তোমার একটি মেয়ে আছে। তোমাকে আমি ইঞ্জিনিয়ার বানাতে চাই। কিন্তু ছেলেটি বাসায় ফিরে আসেনি।’ উল্টো আমাকে জবাব দেয়, ‘মা আমি যদি মারা যাই, তাহলে হাজার সন্তান তোমার পাশে দাঁড়াবে। তুমি আমার চিন্তা কোরো না।’
তিনি বলেন, “ছেলের ফোন রাখতেই আমার হাসপাতালে আরও দুটি মরদেহ আসে। আমি দৌড়ে রিকশার কাছে যাই। ভাবতে থাকি এই বুঝি আমার ছেলে হাসপাতালে এলো। এ সময় বুকে গুলিবিদ্ধ এক ছেলে হাসপাতালে আসে। আমি তাকে এক্স-রে কক্ষে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ছেলেটি তার মাকে ফোন করে বলে ‘আম্মু আমি ভালো আছি’। আরেকজন আহত ছেলেকে আমি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই ছেলেটিও নিজের পাশে থাকা বন্ধুকে বলছিল- ‘আমার অবস্থা আম্মুকে বোলো না, তাকে বোলো আমি ভালো আছি। না হলে আম্মু অনেক চিন্তা করবে।’ এসব ভয়াবহ অবস্থা দেখে আমি আমার ছেলেকে বারবার ফোন দিতে থাকি। এর পর আবার তাকে ফোন করে বলি- ‘যদি আন্দোলন করতেই চাও তাহলে এখানে না থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও। সেখানে তোমার আরও আন্দোলনকারীরা রয়েছে। উত্তরে আমার ছেলে বলে, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো আম্মু? আমার ভাই-বোনরা গুলি খাচ্ছে, মারা যাচ্ছে। তাদের রেখে আমি কীভাবে জাহাঙ্গীরনগরে যাব?”
সর্বশেষ বিকেল পৌনে ৩টার দিকে আবার ছেলেকে ফোন দেন শাহীনা। তখন মাকে সজল বলেন- ‘তুমি কেন আমাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো আম্মু? আমি যদি শহিদ হই তাহলে আমার আইডি কার্ড দেখে আমাকে শনাক্ত কোরো।’ ২টা ৫৫ মিনিটের দিকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা শাহীনার উদ্দেশে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। সজলকে আসতে বলো।’ এরপর ছেলেকে দুবার ফোন দেন তিনি। কিন্তু ফোন কেটে দেওয়া হয়। পরে অনবরত কল করলেও কেউ রিসিভ করেনি। এক পর্যায়ে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
একমাত্র ছেলের খবর না পেয়ে সজলের সব বন্ধু-বান্ধবকে কল দিয়ে বাইপাইল এলাকায় খোঁজ নিতে বলেন শাহীনা। সজলের বন্ধুরা বলেন, ‘এখানে অনবরত গুলি হচ্ছে। আমরা খোঁজ নিতে পারছি না। আশুলিয়া থানার সামনে আমরা যেতে পারছি না।’ শাহীনা খোঁজ নিতে যেতে পারেননি। কারণ হাসপাতালে প্রচুর গুলিবিদ্ধ আহত লোক আসছিলেন।
সজলের মা বলেন, “সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে হাসপাতাল থেকে আমি ছেলের খোঁজে বের হই। আমার সঙ্গে সজলের বন্ধু শান্ত ছিল। আমি আশপাশে থাকা সব হাসপাতালে ছেলের খোঁজ করি। কিন্তু পাইনি। আমি আইসিইউতে ঢুকেও রোগীদের মুখ দেখে ছেলেকে খুঁজেছি। সব বেওয়ারিশ লাশ উল্টেপাল্টেও দেখেছি। ওই সময় তারা আমাকে লাশ দেখতে নিষেধ করছিলেন। কারণ, তারা বলছিলেন- ‘আপনি মা, আপনি সহ্য করতে পারবেন না। নিহতদের মাথায়, বুকে গুলি লেগে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এসব দেখলে আপনি পড়ে যেতে পারেন।’ আমার স্বামীও বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলের সন্ধানে বের হন। কিন্তু কোনো সন্ধান মেলেনি। সারা দিন-রাত তথা ভোর ৩.৫০ মিনিট পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করে আমি বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে বাইপাইল মোড়ে আসি।”
“ওই সময় সেখানে লাঠিসোঁটা নিয়ে পাহারা দিচ্ছিল ছাত্ররা। তাদের কাছে আমার ছেলের সন্ধান জানতে চেয়ে মোবাইলে থাকা ছবি দেখাই। তখন একজন ছেলে আমাকে বলে, ‘আন্টি আপনি যদি সহ্য করতে পারেন, তাহলে আমি আপনাকে একটা খবর বলতে চাই।’ তখন আমি বললাম বাবা আমি আমার ছেলেকে পাওয়ার জন্য সবকিছু সহ্য করতে প্রস্তুত আছি। তুমি বলো। তখন সে ছেলেটি আমাকে বলে, ‘আশুলিয়া থানার সামনে ছয়-সাতটি ছেলেকে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আপনি সেখানে আপনার ছেলেকে খুঁজে দেখতে পারেন।’ তখন আশুলিয়া থানায় যেতে চাইলে অন্য ছাত্ররা যেতে দেয়নি। তারা আমাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়।”
বাসায় ফিরেই তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করেন শাহীনা। ফজরের নামাজ শেষে সকাল ৬টার দিকে বাসা থেকে ফের বের হন ছেলের সন্ধানে। সাড়ে ৬টায় আশুলিয়া থানার সামনে পৌঁছান তিনি। সেখানে গেলে পুলিশের একটি পিকআপভ্যানে বেশ কয়েকটি পোড়া লাশ দেখতে পান। অনেকে লাশগুলোর ছবি-ভিডিও করছিলেন। ভিড় ঠেলে সামনে যান শাহীনাও। একটা ছবি তোলেন।
শাহীনা আরও বলেন, “একটি লাশ এমনভাবে পুড়েছে যে, পায়ের একটি মোটা হাড় উঁচু হয়ে রয়েছে। ওই হাড়ের সঙ্গে একটি জুতা পোড়া অবস্থায় ঝুলছে। সামান্য স্পর্শ করলেই জুতাটা পড়ে যাবে। আর ওই জুতা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, ‘এই জুতাটি আমার ছেলে সজলের। (এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এই সাক্ষী।) আমি তখন উপস্থিত সেনাসদস্যদের বলি, ‘এটাই আমার ছেলের লাশ। দয়াকরে আমার ছেলের লাশ আমাকে দিয়ে দিন।’ তখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে বলেন, ‘এখন লাশ দেওয়ার অনুমতি নেই। অনুমতি পেলে আপনাকে জানাব।’ নিরুপায় হয়ে আমার ছেলের লাশ ফেরত পেতে আমার কর্মস্থলের হাসপাতালের চিকিৎসকদের সহায়তা করার অনুরোধ করি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সজলের বন্ধুরা আমাকে ফোন দিয়ে আশুলিয়া থানায় যেতে বলে। বিকেল ৫টায় সেখানে পৌঁছাই।”
তিনি বলেন, ‘থানায় যেতেই দেখি গাড়ি থেকে একটার পর একটা পোড়া লাশ নামিয়ে শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাকে লাশের কাছে যেতে দেন। এ সময় একটি লাশ নামানোর সময় নিজের কর্মস্থলের আইডি কার্ড (আংশিক পোড়া) দেখে সজলকে শনাক্ত করি। মানিব্যাগের ভেতরে ছেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডও দেখি। রক্তমাখা সেই আইডি কার্ডটি দেখানো করা হয়।’
জবানবন্দিতে এই সাক্ষী বলেন, ‘আমার ছেলের লাশের ছবি তোলার সময় দেখি পোড়া হাতের পাশেই মোবাইল ফোনটি। এটা দেখে বুঝতে পারি যে, পোড়ানোর আগ মুহূর্তেও ছেলেটি জীবিত ছিল। ফোন দিয়ে কাউকে কিছু জানানোর চেষ্টা করছিল। আমার মনে হয়েছে, যখন তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল তখন সে প্রাণপনে নিজের অবস্থা আমাদের জানানোর চেষ্টা করছিল বা কোনো মেসেজ লেখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু একটার ওপর আরেকটা লাশ ফেলার কারণে নিচে পড়ে যাওয়ায় আর কোনো মেসেজ লেখা বা কল দেওয়ার সুযোগ পায়নি।’
এ সময় বিচার চেয়ে শাহীনা বলেন, ‘আমার সন্তানসহ দুই হাজার মানুষকে যারা হত্যা করেছে সেই আসামিরাসহ এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এমপি সাইফুল আলম, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগ ও পুলিশ সদস্যদের বিচার চাই।’
ট্রাইব্যুনালে এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম ও প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।