ঢাকা: দুই দিনের সরকারি সফরে আজ শনিবার (২৩ আগস্ট) ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। দ্বিপক্ষীয় এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্তরে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে আসছেন তিনি। সফরে পাঁচ থেকে ছয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সইয়ের কথা রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সফরের দ্বিতীয় দিন রোববার পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মূল বৈঠকটি হবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। ওই দিন দুই মন্ত্রী শুরুতে একান্তে এবং পরে প্রতিনিধি পর্যায়ে বৈঠক করবেন। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি চুক্তি ও এমওইউ সইয়ের কথা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে জানা গেছে, তৌহিদ-দারের বৈঠকে ব্যবসা, বিনিয়োগ, সংযুক্তি, নানা পর্যায়ে দুই দেশের লোকজনের চলাচল সুগম করাসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় আলোচনায় থাকবে। পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকের ধারাবাহিকতায় এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া ও অভিন্ন স্বার্থে জোর দেবে বাংলাদেশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের সম্পর্ক যেখানে এসেছে, তা এগিয়ে নিতে হলে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সুরাহা জরুরি।
দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে এই সম্পর্ক অমীমাংসিত তিনটি ঐতিহাসিক ইস্যুকে বাদ দিয়ে হবে না। অমীমাংসিত বিষয়গুলো হলো—একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়া, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন ও অবিভাজিত সম্পদে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রদান।
কি কি চুক্তি থাকছে?
দুই দেশের মধ্যে সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের ভিসা বিলোপ চুক্তি সইয়ের কথা রয়েছে। এ ছাড়া দুই দেশের বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন, সংস্কৃতি বিনিময়, দুই দেশের মধ্যে ফরেন সার্ভিস একাডেমির সহযোগিতা, দুই রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সঙ্গে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইপিআরআই) মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ক সমঝোতা ও চুক্তি সইয়ের কথা রয়েছে।
রোববার (২৩ আগস্ট) বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ইসহাক দার।
কূটনৈতিক সূত্রের বরাতে জানা গেছে, ঢাকা সফরকালে ইসহাক দার বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। তারই অংশ হিসেবে দার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার গুলশানের বাসায় দেখা করতে যাবেন। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গেও সাক্ষাতের কথা রয়েছে দারের।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। প্রায় দেড় যুগ পর স্থবির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিতে বেশ আগ্রহী ইসলামাবাদ। তারই অংশ হিসেবে দীর্ঘ ১৫ বছর পর গত এপ্রিলে ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক করে বাংলাদেশ-পাকিস্তান। বৈঠকে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ।
কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশের মাটিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে দুবার সাক্ষাৎ হয়েছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। প্রথমে নিউইয়র্ক ও পরে মিশরে। শুধু তাই নয়, সরকার পরিবর্তনের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বেশকিছু দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা গেছে। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—দুই দেশের মধ্যে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনারবাহী একটি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়, যে সুযোগ আগে ছিল না।
গত ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশের ভিসাপ্রাপ্তি সহজ করার নির্দেশ দেয়। আগে পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত উন্নত দেশের নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র লাগত। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, বাংলাদেশিদের জন্য পাকিস্তানের ভিসার চার্জ লাগবে না। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি উড়োজাহাজ চলাচলের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইতোমধ্যে চারবার সাক্ষাৎ করেছেন। গত মাসে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) প্রধান হিসেবে ঢাকা সফর করেছেন। এছাড়া, চার দিনের সফরে বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান।
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আন্তরিক বাংলাদেশ। তবে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ভুলে যায়নি ঢাকা। বাংলাদেশ মনে করে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া, যুদ্ধের জন্য ক্ষতিপূরণ, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসন, সম্পদের হিস্যা, ১৯৭০ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের ঘূর্ণিঝড়ের সময় দেওয়া বৈদেশিক সহায়তার পাওনা পরিশোধের মতো বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া জরুরি।
দারের সফরে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ঢাকার পক্ষ থেকে তোলা হবে কি না–জানতে চাইলে এক কূটনীতিক বলেন, এগুলো ইস্যুর অংশ। কোনটা তুলবে, কোনটা তুলবে না সেটা নিয়ে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। মোটা দাগে যা যা আছে সব থাকবে। এটা এত আগে থেকে বলা কঠিন, এখনো অনেক সময় বাকি।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পাকিস্তানের অতি আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনকে। তিনি বরাবরই বলে আসছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন বাদ রেখে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনো বার্তা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি। আমরা মোটেই তাদেরকে এ প্রসঙ্গে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করিনি যে, একাত্তরকে বাদ দিয়ে আমরা ভালো সম্পর্ক রাখব। ভালো সম্পর্ক নিশ্চয়ই তৈরি করার চেষ্টা করব, সেখানে একাত্তরও থাকবে।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়টি খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন না পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। তবে তিনি মনে করেন, পাকিস্তান যদি এ সাহসটুকু দেখায়, এখানে ১৯৭১ সালে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা উদ্ধৃত করে তারা যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী হয়, এটা তো দোষের কিছু নয়।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় এসেছিলেন। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০২২ সালের জুলাইয়ে হিনা রাব্বানির আবার ডি-৮ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিনা ঢাকায় আসেননি।
উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল ইসহাক দারের ঢাকা আসার কথা থাকলেও ভারতের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার কারণে সীমান্ত উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে তার সফর স্থগিত করা হয়েছিল।