চট্টগ্রাম ব্যুরো: ৩৫ বছর আগে সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জয় পেয়েছিল জাতীয় ছাত্রলীগ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের প্রার্থী। জাতীয় ছাত্রলীগ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগে বিলীন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সমর্থিত সেই মূল ছাত্রলীগ এখন নিষিদ্ধ সংগঠন।
তবে আজ (১৫ অক্টোবর) ছাত্রলীগবিহীন নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির। ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছয় দফা চাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির ভিপি-জিএস পদে জয় পেয়েছিল শুধু একবার, ১৯৮১ সালে। মূল পদে ছাত্রদল কখনও জয়ের মুখ দেখেনি। অধিকাংশ সময়ই চাকসু ছিল বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগের দখলে। সপ্তম চাকসু নির্বাচনকে ফিরে আসার লড়াই হিসেবে দেখছে ছাত্রশিবির। ছাত্রদল মরিয়া জয়ের স্বাদ পেতে।
এর বাইরেও আলোচনায় আছে ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রফ্রন্টের ‘দ্রোহ পর্ষদ’ প্যানেল আর বামধারার ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’। শিবির-ছাত্রদলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মাঝে উঁকি দিচ্ছেন এই দুই প্যানেলের প্রার্থীরাও। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী লড়াইয়ের আভাস মিলেছে ১৮ দিনের প্রচার-প্রচারণা আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের আলোচনায়।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) চাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে অংশ নিচ্ছে মোট ১৩টি প্যানেল। ভিপি-জিএস-এজিএস পদে অংশ নিচ্ছেন মোট ৬৯ জন প্রার্থী। এদের মধ্যে ছাত্রদল থেকে সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, শাফায়াত ও আইয়ুবুর রহমান তৌফিক, ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে ইব্রাহিম হোসেন রনি, সাঈদ বিন হাবিব ও সাজ্জাদ হোসাইন মুন্না, ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রফ্রন্টের ‘দ্রোহ পর্ষদ’ থেকে ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ, ইফাজ উদ্দিন আহমেদ ও জোনায়েদ কবির শায়র এবং বামধারার বৈচিত্র্যের ঐক্য প্যানেল থেকে ধ্রুব বড়ুয়া, সুদর্শন চাকমা ও জশদ জাকির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন।
অন্যান্যের মধ্যে ছাত্র ফেডারেশন সমর্থিত ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল থেকে আবির বিন জাবেদ, চৌধুরী তাসনিম জাহান শ্রাবণ ও পলাশ দে, বৈষম্যবিরোধী সাবেক সমন্বয়কদের প্যানেল ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন’ থেকে মাহফুজুর রহমান, রশিদ দিনার ও জান্নাতুল ফেরদৌস, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ইসলামী ছাত্র মজলিসের ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে তামজিদ উদ্দিন, সাকিব মাহমুদ রুমি ও রোমান রহমান, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ থেকে আব্দুর রহমান রবিন, মোহাম্মদ আব্দুর রহমান ও আমিনুল ইসলাম রাকিব, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদ’ থেকে সাইদ মো. রেদওয়ান, জিহাদ আরাফাত ও আবদুল্লাহ আল মামুন, অরাজনৈতিক ‘সার্বভৌম শিক্ষার্থী ঐক্য’ থেকে তাওসিফ মুত্তাকি চৌধুরী, মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন ও সাঈদ মোহাম্মদ মুশফিক হাসান, সুফিপন্থী ‘অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য’ থেকে ফরহাদুল ইসলাম, ইয়াসিন উদ্দিন সাকিব ও শহীদুল ইসলাম শাহেদ, বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লবী স্টুডেন্ট ফ্রন্টের ‘রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’ থেকে কেফায়েত উল্লাহ, শাহরিয়ার উল্লাহ ও জোনায়েদ শিবলী যথাক্রমে ভিপি-জিএস-এজিএস পদে প্রার্থী হয়েছেন।
এছাড়া ‘ভয়েস অব সিইউ’ নামে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থীদের একটি প্যানেল থেকে দফতর সম্পাদক, যোগাযোগ ও আবাসন সম্পাদক এবং মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, চাকসু ও হল সংসদের নির্বাচনে এবার মোট ভোটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ হাজার ৫২১ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ছাত্র ভোটার ১৬ হাজার ৮৪ জন ও ছাত্রী ভোটার ১১ হাজার ৩২৯ জন। অর্থাৎ মোট ভোটারের ৪০ শতাংশই ছাত্রী। তারাই ভোটে জয়-পরাজয়ের নির্ধারক হবেন- এমন ধারণা নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীদের।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭০ সালে প্রথম ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের মোহাম্মদ ইব্রাহিম এবং জিএস হন ছাত্রলীগের আবদুর রব। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়াতে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন চাকসু জিএস আবদুর রব।
১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় চাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের শামসুজ্জামান হীরা ভিপি এবং জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের তৃতীয় চাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগের এস এম ফজলুল হক ভিপি ও গোলাম জিলানী চৌধুরী জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের চতুর্থ চাকসু নির্বাচনে ভিপি হন জাসদ ছাত্রলীগের মাজহারুল হক শাহ চৌধুরী এবং জিএস হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের জমির চৌধুরী। ১৯৮১ সালে চাকসুর পঞ্চম নির্বাচনে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেসময়ের নেতা জসিম উদ্দিন সরকার ও আবদুল গাফফার।
১৯৯০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ চাকসু নির্বাচনে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের প্রার্থী জাতীয় ছাত্রলীগের নাজিম উদ্দিন ভিপি নির্বাচিত হন। আর জিএস নির্বাচিত হন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি আজিম উদ্দিন আহমদ। কিন্তু সর্বশেষ ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা ফারুকুজ্জামান নিহত হলে চাকসুর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ৩৫ বছরে আর চাকসু নির্বাচন হয়নি।