চট্টগ্রাম ব্যুরো: প্রথমবার ঘোষণার পরও বাদ পড়া আবু সুফিয়ান বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ফিরলেন নির্বাচনের লড়াইয়ে। দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে ‘সন্ত্রাসের জনপদে’ পরিণত হওয়া রাউজানে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপরই আস্থা রেখেছে বিএনপি। সন্দ্বীপেও বহাল আগের প্রার্থী। তবে বিএনপির জন্য ‘কঠিন চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বিবেচিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন এক নবাগত।
বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) বিএনপির পক্ষ থেকে দেশের আরও ৩৬ আসনে দলটির মনোনীত প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে চট্টগ্রামেরও ৪টি আসন আছে। রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এর আগে, গত ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল বিএনপি। চট্টগ্রামের মোট ১৬ আসনের মধ্যে প্রথম দফায় ১১টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল, তবে পরে একজনের নাম প্রত্যাহার করা হয়। দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাহার হওয়া ওই আসনসহ ৪টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হলো। এরপরও আরও দুটি আসনের নেতাকর্মীদের তাদের প্রার্থীর নাম জানতে অপেক্ষার প্রহর বাড়ল।
ঘোষিত চারটি আসনের মধ্যে চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে আবু সুফিয়ান, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মোস্তফা কামাল পাশা এবং চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে নাজমুল মোস্তফা আমিনকে প্রার্থী করা হয়েছে।
এদের মধ্যে আবু সুফিয়ানের নাম প্রথম তালিকায়ও ছিল। কিন্তু ঘোষণার পরপরই অজ্ঞাত কারণে সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে এরপরও তিনি নগরীর কেন্দ্রস্থলের ‘কোতোয়ালী-বাকলিয়া’ আসনে প্রচার-প্রচারণা, গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন। ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে উঠে আসা আবু সুফিয়ান চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি দক্ষিণ জেলার আহ্বায়কেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও নগরীর একাংশ) আসনে তিনি বিএনপির মনোনয়ন পেয়ে দুইবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
চট্টগ্রামের আরেক আলোচিত আসন রাউজানে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন দুই হেভিওয়েট নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আওয়ামী লীগের আমলে প্রায় ১৬ বছর রাউজানের বিএনপি নেতাকর্মীরা ‘এলাকাছাড়া’ ছিলেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা ঘরে ফেরেন। তবে এলাকায় ফিরে নেতাকর্মীরা গোলাম আকবর ও গিয়াস কাদের- এ দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘাতে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয় রাউজান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ মাসে রাউজানে খুন হয়েছেন অন্তত ১৭ জন। এর মধ্যে ১২ জনই খুন হয়েছেন বিএনপির দুই গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে।
গত ২৯ জুলাই রাউজানে প্রয়াত এক নেতার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার। এ ঘটনার পর গিয়াস কাদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির পদ হারান। গোলাম আকবরের নেতৃত্বাধীন উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়।
তবে দুই নেতার জোর প্রতিযোগিতার মধ্যে শেষপর্যন্ত মনোনয়ন বাগিয়ে এনেছেন গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তাকে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে রাউজানে তার অনুসারী নেতাকর্মীদের মধ্যে উল্লাস চলছে। গিয়াস কাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ফাঁসি হওয়া সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ভাই। তিনি রাউজান থেকে আগেও বিএনপির মনোনয়নে একাধিকবার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন। এর মধ্যে একবার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাউজানের পাশের আসন রাঙ্গুনিয়ায় মনোনয়ন পেয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচনের মাঠে নেমে পড়েছেন তার ভাতিজা, সালাহউদ্দিন কাদেরের ছেলে হুম্মাম কাদের।
দেশের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ আসনে আবারও মনোনয়ন পেয়েছেন মোস্তফা কামাল পাশা, যিনি আগেও দুই দফায় সেখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে মনোনয়ন পাওয়া নাজমুল মোস্তফা আমিন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র সদস্য ও লোহাগাড়া উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক। মনোনয়নের আশায় লোহাগাড়ায় বছরখানেক ধরে জোর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গেলেও তিনি একেবারেই নবাগত প্রার্থী। ওই আসনে তাকে জামায়াতে ইসলামীর হেভিওয়েট প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীকে নির্বাচনের মাঠে মোকাবিলা করতে হবে। বারবার দলটির প্রার্থী জিতে আসার কারণে এবং ব্যাপক সাংগঠনিক ভিত্তি থাকায় আসনটি ‘জামায়াতের দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত।
প্রথম দফায় চট্টগ্রামের ১০টি আসনে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীরা হলেন, চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে উত্তর জেলার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীর চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে যুবদল নেতা কাজী সালাউদ্দিন, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হুম্মাম কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) আসনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে দক্ষিণ জেলার সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে সাবেক সংসদ সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা।
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) এবং চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি।