‘বার্থ সার্টিফিকেট নেই কিন্তু আনাছের ডেথ সার্টিফিকেট হাতে’
৭ আগস্ট ২০১৯ ২৩:৪২
ঢাকা: আমাদের একমাত্র সন্তান আনাছ। পুরো নাম আনাছ ইবনে হোসাইন। বয়স ৩ বছর ৭ মাস। ওর বার্থ সার্টিফিকেট নেই। এ মাসেই বার্থ সার্টিফিকেট করাব ভেবেছিলাম। সামনের বছর মাদরাসায় ভর্তি করাব। বিয়ের সাত বছর পর আমাদের ঘর আলো করে আসে আনাছ । তাই মানত করেছিলাম, ওকে মাদরাসায় পড়াব। কেবল পড়ালেখা শেখাতে শুরু করেছিলাম। সেদিন নতুন একটা পড়ার টেবিল কিনেছি। ছেলেটা সেই টেবিলে পড়তে বসার আগেই আমাদের বুক খালি করে চলে গেল।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন আয়েশা হোসাইন ও বাবা মনির হোসাইন মুন্না দম্পতি। একদিন আগেই রাজধানীর ফার্মগেট পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা এই দম্পতি হারিয়েছেন তাদের একমাত্র সন্তান।
মা-বাবার কোলে আনাছ
১১ দিন ধরে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটোছুটি, ছেলের পুরো হাত-পা-মাথায় সূঁচের খোঁচাখুঁচি, একমাত্র সন্তানের মৃত্যু— সবকিছু মিলিয়ে চোখের পানি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে মনির-আয়েশা দম্পতির। কিন্তু বুকের ভেতরের হাহাকার আর শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তারা। আনাছের বাবা মনির হোসাইনের সময় তাই কাটছে মসজিদে, সন্তানহারা মা আয়েশা যতটা সময় পারছেন, কাটাচ্ছেন সন্তানের কবরের সামনে। বাকিটা সময় ঘর অন্ধকার করে বিছানার এক কোণায় বসে থাকছেন তসবি হাতে।
বুধবার (৭ আগস্ট) বিকেলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক পৌঁছান মনির হোসাইনের পৈত্রিক বাড়িটিতে। আনাছের প্রসঙ্গ তুলতেই অবাক হয়ে যান আয়েশা। বলেন, কই আমার ছেলের মৃত্যুর কথা তো কেউ জানে না! কোনো খবরে তো আসেনি! কোথায় আপনাদের মেয়র? সরকারের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তালিকায় কি আমার ছেলের নাম আছে?
মোবাইলে ছেলের ছবি দেখান আর কাঁদেন মা আয়শা
কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে সামলে নেন আয়েশা। অস্থির হয়ে খুঁজতে থাকেন ছেলের মেডিকেল রিপোর্ট, ডেথ সার্টিফিকেট। বলেন, ২৪ জুলাই ছেলের জ্বর এলে আমরা প্রথমে যাই ধানমন্ডির কমফোর্ট হাসপাতালে। সেখান পূর্বপরিচিত শিশু বিশেষজ্ঞ একটি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বলেন, সাধারণ জ্বর আর মুখে ঘা আছে, সেরে যাবে। দু’দিনে জ্বর না কমায় আবারও যাই ওই চিকিৎসকের কাছে। সেদিন তিনি ডেঙ্গু টেস্ট দিলে তা পজিটিভ আসে। ওইদিন চিকিৎসক দ্রুত আনাছকে হাসপাতাল নিতে বলেন।
আয়েশা বলেন, বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে একটা সিটের জন্য সেদিন কত যে ছুটলাম। অনুরোধ, অনুনয়, পা পর্যন্ত ধরেছি—হাসপাতালের একটা কোথাও শুধু একটু জায়গা চেয়েছি। শুধু চিকিৎসাটা শুরু হোক, বাসা থেকে চাদর এনে হলেও একটু আশ্রয় চেয়েছি। কেউ শোনেনি।
ছেলে কী করত, তার ভিডিও ধারণ করে রেখেছিলেন; সেই ভিডিও এখন শুধুই স্মৃতি
ধরা গলায় আয়েশা বলেন, পাঁচ-ছয়টা হাসপাতাল ঘুরেও একটাও সিট পেলাম না। রাত ১টায় পান্থপথের একটি হাসপাতালে চিকিৎসককে অনেক অনুরোধ করার পর পুরুষ ওয়ার্ডে একটি সিট মিলল। সেখানে দু’দিন চিকিৎসার পর ছেলের প্লেটলেট ১০ হাজারে নামলে ছেলেকে শিশু নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (পিআইসিইউ) নেওয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকরা। তাদের সুপারিশেই রাজধানীর লালমাটিয়ায় শিশু ও নবজাতক হাসপাতালের পিআইসিইউতে একটা সিট পেলাম। কিন্তু ওখানে খুব কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা।
এবার আয়শা আর মনির ধরে রাখতে পারলেন না নিজেদের। ডুকড়ে কেঁদে ওঠেন আয়শা। বলেন, আনাছের ছোট্ট শরীরটাতে কত যে সিরিঞ্জ ঢুকাতে হয়েছে! সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা— টেস্ট আর টেস্ট। তাতেই বা কী লাভ হলো!
মনির হোসাইন অভিযোগ করে বলেন, ছেলেটার কী হয়েছে , অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে— তা স্পষ্ট করেননি শিশু ও নবজাতক হাসপাতালের চিকিৎসক বা কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে তারা ধমক দিতেন। ভয়ংকর রকমের খারাপ ব্যবহার করতেন নার্স আর ওয়ার্ড বয়রা। এমনকি ছেলের মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে যখন ডাক্তার ডাকতে বললাম নার্সকে, তখনো চিকিৎসক এলেন আধাঘণ্টা পর। বললেন, অন্য রোগীর কাছে ছিলেন।
ঘরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে আনাছের সব খেলনা
মনির বলেন, ছেলেটা মারা গেল মঙ্গলবার সকাল ১১টায়। এর ঘণ্টাদুয়েক আগে চিকিৎসকরা বললেন, ছেলেকে শিশু হাসপাতালের আইসিইউতে নিতে হবে, তারা কথা বলে রেখেছেন। দৌড়ে গেলাম শিশু হাসপাতালে। কথা বললাম, সিটও পেলাম। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। স্ত্রীর ফোন পেলাম, ‘আর আইসিইউ লাগবে না, চলে আসো!’
আয়েশা কান্না যেন আর থামেই না। মোবাইলে অসুস্থ ছেলের ছবি আর ভিডিও দেখিয়ে বলতে থাকেন, কত কষ্ট পেল আমার সোনা বাচ্চাটা। কত কিছু খেতে চাইল হাসপাতালে ভর্তির পর। ছেলে বলে, ‘মা, কেক খাব। মা, পুডিং খাব। মা, স্প্রাইট এনে দিবা? মা, একটু ডিম ভাজা দাও না।’ সব নিয়ে আসতাম। কিন্তু খেতে দেয়নি ওরা। এসব খাবার কি আর আমরা সারাজীবন মুখে তুলতে পারব?
‘জড়িয়ে না ধরলে আমার বাচ্চাটা কোনোদিন ঘুমাত না। এখন কেমন করে অন্ধকার কবরে একা থাকবে! আর কোনোদিন তো আম্মু বলে ডাকবে না আমাকে,’— বলেন আয়েশা। এবার তার কান্না পরিণত হয় ক্ষোভে। বলেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। আমি আদালতে যেতে চাই। আমার বুক খালি হলো, আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়।
ক’দিন আগেই আনাছের জন্য কেনা হয়েছিল পড়ার টেবিল, তাতে কি কেউ বসবে আর!
ক্ষোভ আর কষ্ট একাকার হয়ে যায় আয়েশার কান্নার দমকে। বলেন, কোথায় মশার ওষুধ? কোথায় চিকিৎসা? কোথায় হাসপাতালে সিট? সরকার কি কিছুই দেখছে না? আমাদের কাছে আসতে বলেন, দেখে যাক আমরা কেমন নিঃস্ব। আমাদের জীবনের সব সুখ-আনন্দ-স্বপ্ন সব শেষ। আমার ছেলেকে কবর দিয়ে আসার পর আজ কমিশনারের লোকজন মশার ওষুধ নিয়ে এসেছে। এতদিন কোথায় ছিলেন তারা?
মনির বলেন, ছেলেটা তো সঠিক চিকিৎসা পেলই না। তবু হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে আমাদের দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমরা গরীব। তবু ছেলের জন্য আরও যত টাকাই লাগত, আমরা যেভাবেই হোক ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু সেই চিকিৎসাটাই কেউ দিতে পারল না।
এক সপ্তাহও বাকি নেই কোরবানির ঈদের। সে প্রসঙ্গ আসতেই মনিরের চোখের কোণে আবার জমে ওঠে পানি। বলেন, ছেলেটা বলেছিল— বাবা, এবার একটা লাল গরু কিনবা। সেই ছেলেটার আর ঈদই করা হলো না।
আনাছ লিখতে শিখছিল মাত্রই, সেই হাতের লেখা দেখাচ্ছেন তার মা
আনাছের মা-বাবা, দাদী-নানী-খালা সবাই মিলে এই প্রতিবেদককে দেখাতে থাকেন ঘরজুড়ে আনাছের পোশাক, খেলনা, পড়ার চেয়ার-টেবিল। আনাছের খালা জানালেন, মাত্র ক’দিন আগেই আনাছের পড়ার জন্য টেবিল কেনা হয়েছে। নতুন নতুন হাতের লেখাও শিখছে। খাতা বের করে আনাছের হাতের লেখা দেখালেন আয়শা। বলেন, এই টেবিলটায় আর কেউ কোনোদিন বসবে না!
আনাছদের বাড়িতে প্রতিবেশীদেরও ভিড়। আনাছের নানী বলেন, আনাছের জন্য গোটা মহল্লায় শোক নেমে এসেছে। সবাই যে খুব ভালোবাসত আমার নাতিকে।
প্রতিবেশীদের পরামর্শে বাড়ির পাশেই আনাছকে সমাহিত করা হয়েছে, যেন ওর মা বাসার ছাদ থেকেই ছেলের কবর দেখতে পায়। বাসার জানালা দিয়ে সেই কবরটি দেখানোর চেষ্টা করেন আয়শা। সন্ধ্যার আলোতে ঠিক ঠাহর করা যায় না কবরের জায়গাটি। তবু আয়শা তাকিয়ে থাকেন বাইরে, যেন ঠিক দেখতে পাচ্ছেন— তার আদরের সন্তান শুয়ে রয়েছে চিরনিদ্রায়।
ভিডিও দেখুন:
আনাছ ডেঙ্গু ডেঙ্গুতে মৃত্যু ডেঙ্গুতে শিশুর মৃত্যু ডেথ সাটিফিকেট