সাভার চামড়া শিল্প নগরী: অপ্রস্তুত শোধনাগার, দূষণ বাড়ছে ধলেশ্বরীর
১০ আগস্ট ২০১৯ ১৯:১০
সাভার থেকে ফিরে: ১৫ বছরেও সাভার চামড়া নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। যে কারণে তরল বর্জ্যে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীর দূষণের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া কঠিন বর্জ্যের জন্য ডাম্পিং ইয়ার্ড নিমার্ণের কথা থাকলেও এখনও তা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। ফলে ট্যানরির কঠিন বর্জ্য প্রকল্প এলাকায়ও দূষণের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে।
সরেজমিনে সাভার চামড়া শিল্প নগরী ঘুরে দেখা গেছে, খুবই অল্প সংখ্যক ট্যানারি নিজেদের অস্থায়ী ডাম্পিং ইয়ার্ডের মধ্যে কঠিন বর্জ্য রাখছেন। এছাড়া সিইটিপি ও ডাম্পিং ইয়ার্ড তৈরি না হওয়ায় বেশিরভাগ ট্যানারি তাদের কঠিন বর্জ্য আশপাশের এলাকায় যেখানে সেখানে ফেলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরানোর অন্যতম কারণ ছিল পরিবেশ দূষণ। সাভারে ট্যানারি শিল্পস্থাপনের অন্যতম শর্ত ছিল শোধনাগারসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সরকার নির্মাণ করে দেবে। কিন্তু সময়ক্ষেপণ ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এগুলোর কাজ এখনও শেষ হয়নি। যে কারণে কারখানার মালিকরা চাইলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যতদিন যাচ্ছে আশপাশের পরিবেশ ততই দূষণ হচ্ছে। এই দূষণের হাত থেকে বাঁচছে না ধলেশ্বরী নদীও।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুল হালিম এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘সব দায়িত্ব আমাদের একার না। এখানে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় দায়িত্ব পালন করে। সুতরাং সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তাহলে সিইটিপির যে কয় শতাংশ কাজ বাকি আছে আমরা দ্রুতই সেটা শেষ করতে পারব। ’
এরইমধ্যে ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে দাবি করে তিনি জানান, বাকি ৩ শতাংশ কাজ শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে কত সময় লাগবে সেটা বলতে পারছি না। আর ২০২০ সালের জুনের মধ্যে চামড়া শিল্প নগরীর কাজ পুরোপুরি শেষ হবে।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট সরকার সাভার চামড়া শিল্প নগরী প্রকলেপর অনুমোদন দেন। সাভারের বলিয়াপুরে দুইশ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠছে এই শিল্প নগরী। এর মধ্যে সাড়ে ১৭ একর জায়গায় স্থাপিত হচ্ছে সিইটিপি। প্রকল্পের কাজ ২০০৫ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও শেষ হয়নি। এখন পযর্ন্ত মোট ২০৫টি প্লটের মধ্যে ১৫৫টি ট্যানারি স্থাপন করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, সিইটিপির মাধ্যমে ট্যানারির বর্জ্য পরিশোধন করে বিষমুক্ত তরল পাশ্বর্বর্তী ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হবে। আর আর ডাম্পিং এর বর্জ্য দিয়ে তৈরি হবে বিদ্যুৎ। বর্জ্য থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হলেও বাস্তবে কেবলমাত্র সিইটিপি’র কাজ চলছে।
বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ এ বিষয়ে সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। আর সিইটিপির কাজ শেষ না হওয়ায় আমাদেরকে অনেক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। আমরা ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারছি না। ব্যাংকিং সেক্টরেও এটি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর প্রভাব পড়ছে। আমাদের এখানে বায়ারও আসছে না। ফলে আমরা লোকসানে পড়ছি। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যত দ্রুত এটি হবে ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।’
এ বিষয়ে মাইজদী ট্যানারির মালিক মোহাম্মদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ট্যানারি থেকে সিইটিপিতে বর্জ্য আনতে যে পাইপ লাইন স্থাপন করা দরকার তা এখনও বসানো হয়নি। ফলে তারা বাধ্য হয়ে গাড়িতে করে বর্জ্য অস্থায়ী ডাম্পিংয়ে ফেলে আসে। এতে করে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। কিন্তু তারাও নিরুপায়। কাজ তো করতেই হবে। তাই বাধ্য হয়েই বর্জ্য অস্থায়ী ডাম্পিংয়ে ফেলতে হচ্ছে। ২০১৩ সালের মধ্যে সিইটিপির নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এখনও শেষ হয়নি।’
দূষণ বাড়ছে ধলেশ্বরীর
দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সাভারের ট্যানারি পল্লী এখন ধলেশ্বরী নদী দূষণের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যানারির বর্জ্য ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থযুক্ত তরল সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে। আর নির্গত তরলে মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম, ক্ষার, রাসায়নিক উপাদান, লবণসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে।ফলে বুড়িগঙ্গার মত ধলেশ্বরীর দূষণের মাত্রা দিনদিন বাড়ছে।
গত শনিবার (৩ আগস্ট) সাভারের হেমায়েতপুরে অবস্থিত ট্যানারী পল্লী সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পুরো ট্যানারির ৫টি মুখ দিয়ে সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে পড়ছে ট্যানারির বর্জ্যের দূষিত পানি। সাভার ট্যানারীর সিইটিপির খুব কাছেই রয়েছে অস্থায়ী বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশন। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা ট্যানারির সকল প্রকার বর্জ্য ফেলেন। বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানের বাইরেও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আর এই বর্জ্যের পানিও সরাসরি গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে।
এছাড়া শিল্প নগরীর পশ্চিম প্রান্তে ধলেশ্বরী নদীর তীরে উন্মুক্ত স্থানটিতে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, এই স্থানটি ট্যানারির বর্জ্যে ভরে উঠলে রাতের আঁধারে খুলে দেওয়া হয় ভাগাড়ের নদীর তীরবর্তী অংশ। এতে দূষিত আবর্জনার সবকিছু গিয়ে পড়ে ধলেশ্বরীতে। এছাড়া দুগর্ন্ধ পানির কারণে আশেপাশের মানুষদের জন্যও বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে স্থানটি।
ট্যানারির কর্মকর্তা-শ্রমিক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু যে নদী দূষণ হচ্ছে, তা নয়। ট্যানারির ময়লার দুর্গন্ধে বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির সময় প্রকল্প এলাকা পানি আর কাদায় মিশে একাকার হয়ে যায়। এসময় ট্যানারি বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ভেসে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
বালিয়াপুরের প্রকল্প এলাকার পাশেই থাকেন সাভারের একটি পোশাক কারখানার ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম শপথ। তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, এই চামড়া নগরী এখন স্থানীয়দের কাছে অভিশাপের মত। দিন যত যাচ্ছে, প্রকল্প এলাকার চারপাশে দূষণের মাত্রা তত বাড়ছে। ধলেশ্বরী নদীর প্রকল্প এলাকার অংশে এখনই পানি কালো গড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া আশপাশের যেসব ফসলি জমি আছে, সেগুলোতেও উৎপাদন কমে আসছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুব আলম এই প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, ‘পরিবেশের কথা চিন্তা করে হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে সাভার নিয়ে যাওয়া হলো ট্যানারি। এখানেও সমাধান মিলছে না। নিয়ম-নীতির বিষয়ে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। নয়তো ট্যানারিগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কেননা বুড়িগঙ্গা রক্ষা করার জন্য ট্যানারি নেওয়া হলো সাভারে; কিন্তু সাভারে গিয়েও নষ্ট করা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদী। আর প্রকল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরও গাফিলতি রয়েছে।’