১৫ বছরে শেষ হয়নি বিচার, ৯ মাসেও তৈরি হয়নি পেপারবুক
২১ আগস্ট ২০১৯ ০৭:৫৫
ঢাকা: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দেশের ইতিহাসের বর্বোরচিত গ্রেনেড হামলার ১৫ বছর পরও শেষ হয়নি এর বিচারকাজ। গত বছর বিচারিক আদালত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। তবে এরপর ডেথ রেফারেন্সসহ আসামিদের আপিল আবেদনের ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও শুরু হয়নি সেই আপিলের শুনানি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সারাবাংলাকে বলেন, ডেথ রেফারেন্স হিসেবে মামলাটি হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। এখন ডেথ রেফারেন্স মামলায় প্রথমত রাষ্ট্রপক্ষ পেপারবুক তৈরি করে। পেপারবুক তৈরি হলেই আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।
আরও পড়ুন- ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: বর্বরোচিত নৃশংসতার দেড় দশক
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তাই এর পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরি করবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, বিডিআরের মামলায় এরকম বিশেষ ব্যবস্থায় পেপারবুক তৈরি হয়েছিল। এ মামলাটিও আমি সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের গোচরে নেব, যেন পেপারবুক তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। পেপারবুক তৈরি হলেই ডেথ রেফারেন্স মামলাটি শুনানি হবে। ডেথ রেফারেন্স মামলার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য যারা আপিল করেছেন বা যারা জেল আপিল করেছেন, একইসঙ্গে শুনানি হবে।
এটি একটি রাজনৈতিক মামলা এবং রাজনৈতিক কারণেই রাজনৈতিক নেতাদের সাজা দেওয়া হয়েছে— বিএনপির এমন দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, চারদিক থেকে গ্রেনেড হামলা করা হলো, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গেল না। তারপরে যারা ঊর্ধ্বতন ক্ষমতায় ছিলেন, তারাও গেলেন না। এবং এ ঘটনার পরপরই মওলানা তাজউদ্দিনকে দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়া হলো। অন্যান্য যারা এই হামলায় জড়িত, তারাও পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেন। সবকিছুতে তো এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এই হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলকে তার নেতা-নেত্রীসহ নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্যই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
আরও পড়ুন- শ্রবণশক্তির স্থায়ী ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন শেখ হাসিনা
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সবশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, মামলাটির পেপারবুক তৈরির কাজ চলছে। এখনো পেপারবুক তৈরি শেষ হয়নি। পেপারবুক তৈরি হলেই আপিল শুনানি শুরু হবে।
গত বছরের ১০ অক্টোবর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। একইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আরও ১১ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- ‘২১ আগস্ট হাঁটার শক্তি কেড়ে নিয়েছে, তবু রাজনীতি ছাড়িনি’
রায় ঘোষণার দেড় মাস পর গত বছরের ২৭ নভেম্বর দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। এরপর এ মামলার পেপারবুক তৈরি করার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি।
গত ১৩ জানুয়ারি বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য গ্রহণ করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এছাড়া গত ২১ জানুয়ারি বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে এ মামলায় দুই বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক দুই আইজিপি শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদা জামিন নিয়ে নেন। এছাড়া ৪৪ আসামির আপিল আবেদন শুনানির জন্য অপেক্ষমান রয়েছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেদিন অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।
আরও পড়ুন- বিএনপির দৃষ্টিতে ২১ আগস্ট
তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তখন জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই ওই হামলার ছক করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিল হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২।
দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে গত বছরের ১০ অক্টোবর মামলার ঐতিহাসিক রায় প্রদান করা হয়। রায়ে ৪৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়।
চাঞ্চল্যকর এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ওই সময়ের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম। অন্যদিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়াসহ অন্যরা।
এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিনসহ ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন আদালত।