২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে ১০ দিনের ‘লকডাউন’
২৪ মার্চ ২০২০ ২৩:০২
ঢাকা: চলমান করোনাভাইরাসের দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা পেতে নাগরিকদের নিজ নিজ বাসায় থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। আর সে কারণেই সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে ঘোষণা করা হয়েছে সাধারণ ছুটি। এর মধ্যে বিদেশ ফেরতসহ তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থাপনা ও সবার জন্য পালনীয় ‘সামাজিক দূরত্ব’ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সহায়তায় রয়েছে সশস্ত্র বাহিনী। তবে করোনা প্রতিরোধে সরকার লকডাউন ঘোষণা না করলেও এই সময়ে সড়ক, নৌ ও আকাশ পথে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধের ঘোষণা এসেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছ থেকে। এর আগেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আলেম-ওলামারা মসজিদে যাতায়াতেও সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। ফলে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের দিন থেকে পরবর্তী ১০ দিনের জন্য দেশ কার্যত চলে যাবে লকডাউনে।
সোমবার (২৩ মার্চ) বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের পক্ষ থেকে সারাদেশে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এসময় সবাইকে যার যার মতো করে ঘরে অবস্থান করতে বলা হয়, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে বলা হয়। এ আদেশ অমান্য করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। এসময় আরও জানানো হয়, খাদ্য সরবরাহ, ব্যাংকিং কার্যক্রম, ফার্মেসি ও হাসপাতালসহ জরুরি সেবা এ নির্দেশনার বাইরে থাকবে।
এই দুর্যোগের মধ্যেও ভালো খবর, আগামী ২৬ মার্চ চীন থেকে করোনাভাইরাস শনাক্তের কিটসহ বিপুল পরিমাণ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর ফলে আরও বেশি বেশি সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার আওতায় আনা যাবে। স্বাস্থ্যকর্মীরাও সুরক্ষা নিয়ে সেবা দিতে পারবেন।
আরও পড়ুন- ছাড়ছেন ঢাকা, বাড়াচ্ছেন শঙ্কা, গুণছেন চারগুণ ভাড়া
সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব ব্রিফিংয়ে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) সকালে ভিডিও বার্তায় যুক্ত হন সাংবাদিকদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আগামী ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে গণপরিবহন লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ওষুধ, জরুরি সেবা, জ্বালানি, পচনশীল পণ্য পরিবহন এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। পণ্যবাহী যানবাহনে কোনো যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
পরে দুপুরের দিকে নৌরুটে চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ)। জানানো হয়, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, শিমুলিয়া-কাঠালবাড়ি, আরিচা-নগরবাড়িসহ সব নৌরুটে ফেরি ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে মঙ্গলবার থেকেই।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে রেলপথ বিষয়ক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সংবাদ সম্মেলন করে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলও বন্ধ থাকবে। মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশের সব অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
আরও পড়ুন- করোনার বিস্তৃতি রোধে যে ১০ নির্দেশনা সরকারের
এদিন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবরের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের আদালতের কার্যক্রমও বন্ধ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলা ও এর বিস্তার রোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর ধারাবাহিকতায় আগামী ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগ ও সব অধস্তন আদালতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো।
মঙ্গলবার সাতটি পোশাক কারখানাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিজিএমইএ’র পরিচালক আসিফ ইব্রাহিম মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) সারাবাংলাকে বলেন, ‘শ্রম আইনের সব বিধিমালা অনুসরণ করে আমাদের সাতটি কারখানার মালিকেরা নিজেরাই ছুটি ঘোষণা করেছি।’
এদিকে, সরকারের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর অনেককেই তড়িঘড়ি করে ঢাকা ছাড়তে দেখা যায় দিনভর। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে ছিল উপচে পড়া ভিড়। এই সাধারণ ছুটি যে অন্য সময়ের সাধারণ ছুটির মতো নয়, সে বিষয়টিই মনে করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
সরকারে নির্দেশনা অনুযায়ী সবাইকে বাসায় থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। পরিষ্কার বলতে চাই, এই ছুটি উৎসব করার জন্য নয়, করোনা প্রতিরোধের জন্য। এটি কোনো উৎসবের জন্য দেওয়া হয়নি। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের মূলমন্ত্র— যার যার ঘরে থাকুন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করুন। তার জন্য ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি। এর মানে হচ্ছে এই ছুটির মধ্যে সবাই বাসায় থাকবেন।
আরও পড়ুন- ২৬ মার্চ থেকে ১০ দিন সাধারণ ছুটি
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আরও বলেন, আমি সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতি ঘরে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কোনোভাবেই ঘরের বাইরে যাবেন না। জরুরি প্রয়োজনে যদি যেতে হয়, তাহলে স্যানিটাইজেশন ও সব ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েই যাবেন। অনুগ্রহপূর্বক এই নির্দেশনা মানার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
এদিকে, মসজিদে মুসল্লিদের উপস্থিতি সীমিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন আলেম-ওলামারা। মঙ্গলবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনে এক বৈঠকে আলেম-ওলামরা এমন মত দিয়েছেন। বিষয়টি সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সহকারী জনসংযোগ কর্মকর্তা সায়লা শারমিন।
করোনার বিস্তার রোধে পুলিশ কাজ করছে জানিয়ে মঙ্গলবার বিজ্ঞপ্তি পাঠায় পুলিশ সদর দফতর। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বাংলাদেশ পুলিশের সব ইউনিট সম্মিলিতভাবে কাজ করছে। সময়ে সময়ে সরকার যে নির্দেশনা দিচ্ছে, তা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা। এরই মধ্যে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের হোম কোয়ারেইনটাইন নিশ্চিত করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
স্বাভাবিক কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও খাদ্যপণ্যের সরবরাহ যেন স্বাভাবিক থাকে, সেদিকেও মনোযোগ রয়েছে সরকারের। মঙ্গলবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র তথ্য অফিসার ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আব্দুল লতিফ বকসীর সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করতে এবং পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখাসহ বাজার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখার স্বার্থে টিসিবি এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
এদিন, রাজধানীর মহাখালীর রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে অনলাইনে নিয়মিত প্রেস বিফ্রিংয়ে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ছয় জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৯-এ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত আরও একজন মারা যাওয়ায় এ ভাইরাসের আক্রমণে মোট চার জনের মৃত্যু হলো বাংলাদেশে।
করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়লেও আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, করোনা প্রতিরোধে সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এসব পদক্ষেপ মেনে চলতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। এর জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার আবশ্যক নয়, সাবান-পানি হলেও চলবে। অপরিষ্কার হাতে নাক-মুখ স্পর্শ না করা এবং হাঁচি-কাশির শিষ্টাচারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধিও মেনে চলার আহ্বান জানান তিনি।
১০ দিনের সাধারণ ছুটি গণপরিবহন বন্ধ ট্রেন চলাচল বন্ধ নৌরুট বন্ধ লকডাউন সাধারণ ছুটি