নিস্তব্ধ ৭০ লাখ মানুষের শহর
২৬ মার্চ ২০২০ ১৮:২৬
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ব্যস্ত বন্দরনগরী যেন তার রূপ হারিয়েছে! সড়কে যানবাহন নেই, মোড়ে-মোড়ে ভিড় নেই, মানুষ নেই, জটলা নেই। খালি সড়কে পথ চলতে গিয়ে মাঝে মাঝে দেখা মেলে রিকশার। মাঝে মাঝে দুয়েকটি প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলও খালি সড়ক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। চিরচেনা কোলাহলও নেই। গাড়ির শব্দ নেই, হুইসেল নেই, মানুষের হাঁকডাক নেই।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সরকারের ঘোষিত ১০ দিনের সাধারণ ছুটির প্রথম দিনটিতে এমনই দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।
৭০ লাখ মানুষের শহর এখন অনেকটাই নিস্তব্ধ। অনেকেই শহর ছেড়েছেন, অনেকেই শহরে ঘরবন্দি। জীবিকার তাগিদে বেরোতে হয়েছে কাউকে কাউকে। নিস্তব্ধ শহরের মূল সড়কগুলোতে পুলিশ-সেনাবাহিনীর টহল চলছে। তবে অলিগলিতে কোথাও কোথাও কিশোর-তরুণদের আড্ডা দেখা গেছে। পাড়ায়-পাড়ায় মসজিদ, উপাসনালয়ে লাগানো মাইকে চলছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) করোনা সতর্কতার বার্তা প্রচার।
বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকাল ৮টার দিকে নগরীর হাজারী লেইনের প্রবেশমুখে দেখা যায়, কলাপাতা বিছিয়ে ফুল বিক্রি করছেন প্রায় সত্তরোর্ধ্ব এক নারী। সেই ফুল কিনতে জড়ো হয়েছেন দুই-তিন জন। বাসা থেকে বের হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই নারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে তো সারাদিন বিক্রি করতাম। এখন ঘণ্টাখানেক করে চলে যাব। ভাত তো খেতে হবে।’
লালদিঘীর পাড় থেকে নন্দনকানন, লাভ লেইন হয়ে কাজির দেউড়ি পর্যন্ত এলাকা সুনসান। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন পথচারীর দেখা মিলেছে সকালে। দোকানপাটের মধ্যে ওষুধের দোকান আর মুদির দোকান খোলা দেখা গেছে। কাজীর দেউড়ির কাঁচাবাজারেও ক্রেতার আনাগোনাও তেমন নেই।
কাজির দেউড়ি থেকে ওয়াসার মোড় পর্যন্ত এলাকাও কার্যত ফাঁকা। জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের গেটের সামনে দাঁড়ানো দু’টি রিকশার ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিলেন দু’জন চালক। হোসেন নামে একজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘৬টার (ভোর) সময় বের হয়েছি। এখন বাজে ১০টা। ভাড়া নিছি মাত্র দুইটা। ৪০ টাকা। সারাদিনে ১০০ টাকা ভাড়া মারতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। গ্যারেজের ভাড়াও তো উঠবে না।’
আরেক রিকশাচালক খায়রুল আবার ভিন্ন সমস্যার কথা শোনালেন। বললেন, রাস্তার পাশে টং দোকানগুলো পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে লোকজন জড়ো হয় বেশি। চায়ের টং দোকানগুলো খুলতে দিচ্ছে না পুলিশ। ‘একটা ভাড়া মারলে এককাপ চা খাইতে হয়। পানি খাইতে হয়। গরম পড়তেছে। চা দোকান বন্ধ। রিকশা চালামু ক্যামনে?,’— প্রশ্ন খায়রুলের।
শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে হঠাৎ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তাটাই বেশি। নগরীর খুলশী থানার পলিটেকনিক এলাকার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক নাজমা বেগম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় এমনিতেই বেতন এক-দুই মাস বকেয়া থাকে। আমরা বিজিএমইএ ভবনের সামনে গিয়ে আন্দোলন করি মাঝে মাঝে। তখন বেতন দেয়। এখন তো মনে হচ্ছে বেতন একেবারেই বন্ধ করে দেবে।’
মূল সড়ক ছেড়ে অলিগলির চিত্র আবার কিছুটা ভিন্ন। অধিকাংশ মানুষের মুখে মুখে মাস্ক। কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানের বালাই নেই। নগরীর আসকার দিঘীর পাড় এলাকায় রামকৃঞ্চ মিশনের পাশের গলির মুখে কয়েকজন তরুণ-যুবক আড্ডা দিচ্ছিলেন। একজনের হাতে মোবাইল, তার ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে সেই মোবাইলে কিছু দেখছিলেন আরও চার জন। পাড়ার প্রবীণ গোছের একজন এসে সেখান থেকে সরে বাসায় যাওয়ার তাগাদা দিলেন। মোবাইল হাতে নেওয়া যুবক নির্বিকারভাবে বললেন, গলিতে আর্মি আসছে না। পুলিশ এলে চলে যাবেন।
নগরীর কাজির দেউড়ির দুই নম্বর গলির বিপরীতে একটি ভাতের হোটেলে রীতিমতো লোকজন জড়ো হয়ে ভাত খাচ্ছিলেন। দুপুর ১টার দিকে পুলিশের একটি গাড়ি এসে সেখানে থামে। কয়েকজন রীতিমতো হুড়মুড় করে হোটেল থেকে বেরিয়ে চলে যান। পুলিশ কর্মকর্তা হোটেলে ঢুকে এক টেবিলে একজনের বেশি না বসানোর জন্য মালিককে নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে হোটেল বন্ধ করে দেবার কথাও বলেন।
দুপুরে নগরীর চেরাগি পাহাড় মোড়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন কয়েকজন তরুণ। এমন সময় কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীনের সামনে পড়ে যান তারা। ওসি তাদের থামান এবং অভিভাবকদের কাছে ফোন করে তাদের সন্তান বাইরে ঘোরাঘুরি করছে কেন জানতে চান। ভুল স্বীকার করে এবং বাসা থেকে বের না হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাড়া পান ওই তরুণরা।
ওসি মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু চেরাগি পাহাড় না, বিভিন্ন এলাকায় লোকজনকে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণরা বাইরে বেরোচ্ছে বেশি। আমি তো মারধরের বিপক্ষে, তাই ভিন্ন কৌশল নিয়েছি। রাস্তায় আড্ডা দিতে দেখলেই দাঁড় করিয়ে মা-বাবাকে ফোন করেছি। করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে সন্তান কেন বাইরে ঘোরাফেরা করছে, জানতে চাইছি। অভিভাবক ও সন্তান উভয়ই দুঃখপ্রকাশ করেছেন। আমার কাছে এটি সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ মনে হয়েছে।’
ফাঁকা শহরে টহল দিচ্ছে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। কেউ কেউ সুরক্ষার পোশাকে, কেউ আবার সাধারণ ইউনিফর্মে। জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা সেনাবাহিনীকে নিয়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেনটাইনের বিষয়টি তদারক করছেন। নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় হোম কোয়ারেনটাইন না মেনে বাইরে ঘোরাঘুরি করায় বিদেশ ফেরত একজনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামুন আহমেদ অনীক।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী পৌরসভায় দু’টি হোটেল খোলা দেখে তালা লাগিয়ে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমিন। হোটেল দু’টো হলো— হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার সামনে দরবার হোটেল ও শাহজাহান হোটেল। ইউএনও জানিয়েছেন, দরবারের মালিক মো. আজাদকে ৫ হাজার টাকা এবং শাহজাহানের মালিক মো. সরওয়ারকে ২৬০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সেনাবাহিনী, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটের বাইরে নগরীতে সক্রিয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে পরিচ্ছন্নকর্মীরা বৃহস্পতিবার (২৬ মার্চ) সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত জীবাণুনাশক পানি ছিটিয়েছেন।
চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের টিম নগরীর সিনেমা প্যালেস এলাকায় অগ্নিনির্বাপক গাড়ি দিয়ে জীবাণুনাশক পানি ছিটিয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিরর জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকা আন্দরকিল্লায় জীবাণুনাশক পানি ছিটানোর জন্য আমি ফায়ার সার্ভিসকে অনুরোধ করি। ব্লিচিং পাউডারও দিয়েছি। পুরো ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি পাড়া-মহল্লায়, নালা-নর্দমায় জীবাণুনাশক পানি ছিটানো হয়েছে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জীবাণুনাশক স্প্রে নিম্ন আয়ের মানুষ প্রথম দিন সাধারণ ছুটি