১৪ বছরেও শেষ হয়নি কম আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প
৭ জুলাই ২০২০ ০৮:২৯
ঢাকা: সমীক্ষা ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য ৯০০টি ফ্ল্যাট। ২০০৬ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা থাকলেও ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ চারবার এবং ব্যয় দুবার বাড়ানো হয়েছে। তারপরও ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। তাছাড়া এই সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নেই দায়িত্ব পালন করেছে নয়জন প্রকল্প পরিচালক। সেইসঙ্গে রয়েছে নানা ক্রুটি। পরিকল্পনামন্ত্রণা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূলায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এই পরিবীক্ষণ কাজ করেছে সংস্থাটি।
আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে তীব্র আবাসন সংকট বিরাজ করছে। এজন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ‘মোহাম্মদপুর-এফ-ব্লকে সীমিত আয়ের লোকদের নিকট বিক্রয়ের জন্য ৯০০টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয়। স্বল্প জায়গায় পরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মানের মাধ্যমে ঢাকার মোহাম্মদপুরের এফ ব্লকে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পটি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০০৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। পরবর্তী সময়ে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এতেও কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। ফের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এরপরও কাজ শেষ না হওয়ায় আবারও ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ১৬২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। পরবর্তীতে ব্যয় বাড়িয়ে ৩০৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা করা হয়। এরপর ফের ব্যয় বাড়িয়ে ৫০০ কোটি ৩০ লাখ টাকা করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১১ জন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে নিয়োজিত পিডি আরও চারটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। যেটি প্রকল্প বাস্তবায়নের অব্যাহত ধারা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। প্রকল্পের আওতায় অনুমোদিত অঙ্গগুলোর বছরভিত্তিক কর্ম পরিকল্পনা ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) থাকলেও বিগত অর্থবছরগুলোতে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৫টি ভবনের মধ্যে চারটি ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি ১১টি ভবনের কাজের অগ্রগতি ৭৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। ডিপিপি বা আরডিপিপিতে সংযুক্ত ক্রয় পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা তৈরি করা হয়নি। পণ্য ও কাজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন করা হচ্ছে। তবে কাজ ক্রয়ের ক্ষেত্রে দরপত্র আহবান, কার্যাদেশকৃত তারিখ এবং চুক্তি সইয়ের মধ্যে কিছু জায়গায় ব্যত্যয় লক্ষ্য করা গেছে।
প্রকল্পের দুর্বল দিক সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির পরিবেশগত ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। এছাড়া এর বেজলাইন সার্ভে ও প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও প্রকল্পের আওতায় যারা বরাদ্দ পেয়েছেন তাদের যথাসময়ে ফ্ল্যাটের বাস্তব দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। খেলাপি ঠিকাদারের কাছ থেকে পারফরমেন্স সুরক্ষার অর্থ নেওয়া হয়নি। এছাড়া প্রকল্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ৯০০টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৫০টি ফ্ল্যাটের বরাদ্দ এখনও বাকি রয়েছে। ফ্ল্যাটগুলো সময় মতো বরাদ্দ দিতে ব্যর্থ হলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। এছাড়া ফ্ল্যটের বর্তমান মূল্য পূর্ব মূল্যের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় বরাদ্দ পাওয়াদের অনেকের পক্ষে অতিরিক্ত অর্থের যোগান অনিশ্চিত হতে পারে।
প্রকল্পের অবকাঠামো ভৌত অবস্থা ও ডিজাইন পর্যালোচনাসহ বিভিন্ন অঙ্গেও সরেজমিন পরিমাণ ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূল অবকাঠামোগত নকশা বাংলাদেশ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে করা হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সাইটে পর্যাপ্ত নকশার উপস্থিতি ছাড়াই (বিল্ডিং ন. ১১) কাজ করতে দেখা গেছে। এছাড়া ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ভবনের ড্রেনের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয়নি। চলমান নির্মাণ কাজের দুয়েকটি বিম ও কলামের ঢালাই কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। ফলে হানিকম্ব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং ওই অবস্থায়ই প্লাস্টারিং করা হচ্ছে।
এদিকে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে ভূমি অধিগ্রহণ ও দখল কাজ শেষ করা যায়নি। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণ ও সাইট হস্তান্তরে দুই বছর সময় লেগেছে। স্ট্রাকচারাল ড্রইং ও নকশা পেতে বিলম্ব, নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিপূরণ দাবি ও বিরোধ নিষ্পপত্তিতে বিলম্ব, পাইল ড্রাইভের সময় স্থানীয় জনসাধারণের বাধার কারণে প্রায় দুই বছর কাজ বন্ধ থাকা, ভেরিয়েশন অর্ডার অনুমোদনে বিলম্ব, বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের আদালতে আরবিট্রেশন মামলা করা এবং ১১ জন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে।
এ বিষয়ে আইএমইডি’র সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘জুন মাসের শেষ দিকে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। শিগগিরই এটি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, যাতে বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হয়। সেইসঙ্গে আগামী আগামীতে এ ধরণের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার আগে এ প্রকল্পের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগানোর জন্য প্রতিবেদনটি সহায়ক হবে বলে মনে করছি।’