Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্র পরিত্যক্ত, জনবল সংকটে অচল উদ্ভিদ কেন্দ্র


২৯ অক্টোবর ২০২০ ০৮:১৯

চুয়াডাঙ্গা: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্র। কার্যক্রম চালু না হওয়ায় সেটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এমনকি এটি যে একটি সংগনিরোধ কেন্দ্র, সেটি বোঝাতে কেন্দ্রের আশপাশে কোথাও কোনো সাইনবোর্ডও নেই।

এদিকে, একই স্থানে গড়ে তোলা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রটিও জনবল সংকটে গতি হারিয়েছে। গত ছয় অর্থবছরে এ কেন্দ্রটি থেকে সরকারের আয় মাত্র হয়েছে ২ কোটি ৯৯ লাখ ৭৯ হাজার ৬২ টাকা। তবে অভিযোগ রয়েছে, একই সময়ে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের রেলওয়াগানের ছাড়পত্র দিতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছ থেকে ঘুষই নেওয়া হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার বেশি।

বিজ্ঞাপন

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে প্রাণী রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় প্রাণিসম্পদ সংগনিরোধ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়। ৬ শতক জমির ওপর কেন্দ্রটি স্থাপন করতে ব্যয় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। নির্মাণের পর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কাছে কেন্দ্রটি হস্তান্তর করে ২০১৮ সালে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারত থেকে বৈধভাবে আসা প্রাণীদের ওষুধ ও ভ্যাকসিন দেওয়া এবং প্রাণী ৭ থেকে ১৪ দিন রেখে রোগ নির্ণয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এ স্থাপনায় কোনো কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় এটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দিনে ও রাতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিযুক্ত দু’জন প্রহরী ভবনটি পাহারা দেন। দু’জনের মধ্যে একজন সার্বক্ষণিক ভবনটিতেই অবস্থান করেন। আরেকজনের বাড়ি পার্শ্ববর্তী জয়নগর এলাকায় হওয়ায় তাকে ভবনের পাহারায় খুব একটা দেখা যায় না।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দর্শনার জয়নগর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে গিয়ে দেখা যায়, প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্রটির কোথাও কোনো সাইনবোর্ড নেই। বৃষ্টির পানিতে ভবনের দেয়ালের রঙ বদলে গেছে। ওপরের কিছু অংশে বৃষ্টির পানি ঠেকাতে পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে দামুড়হুদা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মশিউর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, দেশের ২৫টি স্থানে ‘লাইভ স্টক কোয়ারেন্টাইন’ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল ঢাকা বিমানবন্দর ও যশোরের বেনাপোলে স্থাপিত কেন্দ্র দু’টি চালু রয়েছে। প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে এলেও জনবল নিয়োগ না হওয়ায় চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, সাতক্ষীরার ভোমরা ও বাগেরহাটের মোংলার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকে প্রাণী সংগনিরোধ কার্যক্রম চালু যায়নি। একেকটি কেন্দ্র চালু করতে চাইলে কমপক্ষে একজন সহকারী পরিচালক, একজন ভেটেরিনারি সার্জন, দু’জন টেকনেশিয়ান, একজন অফিস সহায়ক ও একজন অফিস সহকারী প্রয়োজন হবে বলে জানান তিনি।

ডা. মশিউর আরও বলেন, দর্শনা ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে নির্মিত প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্রের নিচে অফিস কক্ষ, ল্যাবরেটরি, প্রাণীর চিকিৎসা করানোর স্থান ও ওপরে আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে। জনবল নিয়োগ হলেই কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হবে।

কেন্দ্রটির কোথাও কোনো ধরনের সাইনবোর্ড নেই কেন— জানতে চাইলে দামুড়হুদা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যখন ভবনটি হস্থান্তর করে, তখন তারা কোনো সাইনবোর্ড দিয়ে যায়নি। এখনো সেটা লাগানো যায়নি। আর কেন্দ্রটি কার্যক্রমের মধ্যে নেই বলেও হয়তো বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না।

এদিকে, জনবল সংকটের কারনে দর্শনার উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রটিও তেমন কাজে আসছে না। ১৯৯১-১৯৯২ অর্থবছর থেকে দর্শনায় সংগনিরোধ কেন্দ্রটি চালু হয়। প্রকারভেদে সরকারি ফি জমা নিয়ে এখান থেকে মূলত কৃষি দ্রব্য আমদানি-রফতানির অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে দর্শনা পৌরসভা ভবনের কোলঘেঁষে ২৩ শতক জমির ওপর আধুনিক উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন থেকেই এখানে চলছে জনবল সংকট। ‘বেশি কাজ নেই’ বলে এই কেন্দ্রে কেউ বদলি হয়ে আসতেও চান না বলে জানা গেছে।

এই উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের মূল কাজ হলো সীমান্ত দিয়ে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত কোনো দ্রব্য বা সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের পণ্য এলে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ছাড়পত্র দেওয়া। সে অনুযায়ী এই কেন্দ্রে নিয়ে আসা পণ্য যাচাইয়ের জন্য সরকারি তহবিলে ফি জমা দিতে হয়। তবে স্থানীয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অভিযোগ, সরকারি ফি হিসেবে তহবিলে যা জমা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘রোজগার’ আছে এই কেন্দ্রের।

হয়রানির আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সারাবাংলাকে বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ছাড়পত্র পেতে রেলওয়াগন প্রতি দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে ২ হাজার টাকা করে দিতে হয়। তা না দিলে পণ্যের ছাড়পত্র পেতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যদিকে ঘুষের ২ হাজার টাকা দিলে ওয়াগনে কী আছে, তা যাচাই না করেও ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়।

উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ভারত থেকে এই কেন্দ্র দিয়ে আমদানি পণ্যের ৬ হাজার ৩১১টি রেলওয়াগন থেকে সরকারের আয় ছিল ৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৯৭৩টি রেলওয়াগন থেকে এই আয় ছিল ৫৮ লাখ ৮ হাজার ৫৪০ টাকা, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ৮৭৭টি রেলওয়াগন থেকে ২৮ লাখ ২৭ হাজার ১৫ টাকা। এছাড়া ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০ হাজার ৬৫৯টি ওয়াগান থেকে ৯৮ লাখ ১৭ হাজার ৮৫৬ টাকা, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ১৮৭টি ওয়াগন থেকে ৩৭ লাখ ১৮ হাজার ৯৯৯ টাকা এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৯৫৫টি ওয়াগন থেকে ৪১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩৫ টাকা আয় হয় এই কেন্দ্রের মাধ্যমে।

এদিকে, অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এসব পণ্য ছাড় করার জন্য ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ১ কোটি ২৬ লাখ ২২ হাজার টাকা, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৯৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ২ কোটি ১৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৬৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৩৯ লাখ ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।

এই হিসাব অনুযায়ী, গত ছয়টি অর্থবছরে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র থেকে সরকারের মোট আয় ছিল ২ কোটি ৯৯ লাখ ৭৯ হাজার ৬২ টাকা। অন্যদিকে একই সময়ে এই কেন্দ্র থেকে পণ্যের ছাড়পত্র পেতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ঘুষই দিতে হয়েছে ৫ কোটি ৫৯ লাখ ২৪ হাজার টাকা।

দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সেখানে উদ্ভিদ সংগনিরোধ রোগতত্ত্ববিদ, স্টোর কিপার ও অফিস সহকারী নেই। ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রেষণে দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে কর্মরত উপসহকারী সংগনিরোধ কর্মকর্তা, উদ্ভিদ পর্যবেক্ষক, অফিস সহায়ক, অফিস গার্ড, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা উপজেলা ও মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা কৃষি অফিস থেকে দু’জন ঝাড়ুদার প্রেষণে এই কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করছেন।

ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলা কৃষি কার্যালয় থেকে প্রেষণে দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে কাজ করছেন উপসহকারী সংগনিরোধ কর্মকর্তা সেলিনুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, গোটা সংগনিরোধ কেন্দ্রের কার্যক্রম তাকেই চালাতে হচ্ছে। তিনি নিজেই পণ্য পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেন।

২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল দর্শনা উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে অতিরিক্ত উপপরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কামরুন নাহার। তিনি চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরে গত ১৮ মে দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে ওই পদে যোগ দেন।

মনিরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, জনবলের তীব্র সংকট থাকায় দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালনা করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে করোনাভাইরাসের প্রকোপের এই সময়টিতে ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রেন আসছে কম। ফলে এই মুহূর্তে কাজের চাপ তেমন একটা নেই। তবে পণ্য আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক গতি পেলেই আমাদের কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে।

ভারত থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যবাহী রেলওয়াগান প্রতি ২ হাজার টাকা নেওয়া হয় বলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মনিরুজ্জামান বলেন, এ সম্পর্কে কিছু জানেন না তিনি।

চুয়াডাঙ্গা জনবল সংকটে অচল উদ্ভিদ কেন্দ্র পরিত্যক্ত প্রাণী সংগনিরোধ কেন্দ্র

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর